দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাইট বা বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ফ্লোর প্রাইসও কমে আসার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নতুন সিদ্ধান্তের পর তৈরি হয়েছে অনেক প্রশ্ন। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস বর্তমান ফ্লোরের তিন ভাগের এক ভাগ হবে। কিন্তু এর আগে বোনাস দিয়ে মুন্নু এগ্রোর শেয়ার সংখ্যা ১০ শতাংশ আর রাইট শেয়ার দিয়ে ন্যাশনাল পলিমারের শেয়ার সংখ্যা শতভাগ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় না হওয়ায় এই দুই কোম্পানির শেয়ারধারীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুনাফা পেয়ে গেছেন।

এ ক্ষেত্রে যারা সমন্বয়ের পর বেশি দামে শেয়ার কিনতে বাধ্য হয়েছেন, বা যারা সুযোগে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কী হবে-সে প্রশ্ন উঠেছে। করোনা সংক্রমণের পর পুঁজিবাজারে মূল্য পতন ঠেকাতে গত বছরের ২২ মার্চ একটি নির্দিষ্ট দরের নিচে দর নামতে পারবে না বলে ঠিক করে দেয় বিএসইসি। এটি পরিচিতি পায় ফ্লোর প্রাইস হিসেবে।

প্রতিটি শেয়ারের এই দর নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় সে সময়। তবে এই দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোম্পানির মৌলভিত্তি বা আয়, সম্পদমূল্য কিছুই বিবেচনা করা হয়নি। কেবল নির্ধারণের আগের পাঁচ কার্যদিবসে শেয়ারের গড় মূল্য বিবেচনায় আনা হয়। সে সময় এই বিষয়টি প্রশংসিত হলেও পরে নানা সমস্যাও দেখা যাচ্ছে।

মুন্নু এগ্রো অ্যান্ড জেনারেল মেশিনারিজ ১০ শতাংশ বোনাস এবং ন্যাশনাল পলিমার ১০০ শতাংশ (একটির বিপরীতে একটি) রাইট শেয়ার দেয়ার পরেও ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় হয়নি। মুন্নু এগ্রোর ফ্লোর প্রাইস ঠিক করা ছিল ৭৯৪ টাকা ৮০ পয়সা। ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার সমন্বয় করা দাম হওয়ার কথা ছিল ৭২০ টাকা। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস এখনও আগের দরেই আছে।

এখন যদি এর ফ্লোর প্রাইস ৭২০ টাকা ঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে এতদিন যারা ৭৯৪ টাকা ৮০ পয়সায় শেয়ার কিনতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আবার গত ৬ জানুয়ারি রাইট শেয়ারের জন্য ক্লোজিং ডেতে ন্যাশনাল পলিমারের দাম ছিল ৭১ টাকা ৬০ পয়সা। প্রতি ১০ শেয়ারে পাঁচ টাকা প্রিমিয়াম নেয়া হয়েছে।

ফলে রাইট শেয়ার যোগ হওয়ার পর মূল্য সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল ৪৩ টাকা ৩০ পয়সা। কিন্তু এই শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস ঠিক করা আছে ৫৬ টাকা ৬০ পয়সা। আর এর নিচে দাম নামতে পারছে না। রাইট শেয়ার সমন্বয়ের পর এই ফ্লোর প্রাইসেই ন্যাশনাল পলিমারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ার হাতবদল হয়েছে।

গত ১০ জানুয়ারি মূল্য সমন্বয়ের দিন দুই লাখ আট হাজার ৫৫৩, ১১ জানুয়ারি এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৪৭, ১২ জানুয়ারি ৯১ হাজার ১২৪, ১৩ জানুয়ারি তিন লাখ ২১ হাজার ৯৭৬, ১৪ জানুয়ারি এক লাখ ৯০ হাজার ৯৩২, ১৭ জানুয়ারি ৫৫ হাজার ৩১ ও ১০ ফেব্রুয়ারি ৫০ হাজার ৭১৫টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে। এ ছাড়াও বাকি সময় গুলোতেও প্রতিদিনই শেয়ার লেনদেন হয়েছে।

সব মিলিয়ে সমন্বয় করা দামে ১১ লাখেরও বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। প্রতি শেয়ারে ১৩ টাকা হিসেবে প্রায় দেড় কোটি টাকা বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। এখন যদি ফ্লোর প্রাইস কমিয়ে দেয়া হয়, তাহলে এই অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোকসান হয়ে যাবে তাদের।

বিএসইসির বিজ্ঞপ্তিতে ফ্লোর প্রাইস নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানানো হলেও এই নীতিমালা বাস্তবায়নের আগে মুন্নু এগ্রো ও ন্যাশনাল পলিমারের বিনিয়োগকারীদের কী হবে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। এ নিয়ে এক প্রশ্নে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিমের কাছেও কোনো জবাব নেই। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।’

সম্প্রতি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি ২০০ শতাংশ, অর্থার একটি শেয়ারের বিপরীতে দুটি শেয়ার বোনাস হিসেবে দেয়ার পর এর ফ্লোর প্রাইস কত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এই কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস ঠিক করা আছে ৯০৭ টাকা ৬০ পয়সা। আগামী ৩ মার্চ রেকর্ড ডেটের পরে একটি শেয়ারধারীরা যখন তিনটি শেয়ারের মালিক হবেন, তখন এই তিনটি শেয়ারের দাম দাঁড়াত দুই হাজার ৭২২ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু এর বাজার দর এখন দেড় হাজার টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ কেবল ফ্লোর প্রাইসের কারণেই এই কোম্পানির শেয়ারধারীরা শেয়ার প্রতি প্রায় ১২০০ টাকা বেশি মুনাফা পেয়ে যেতেন।

তবে বিএসইসি রাইট ও বোনাস শেয়ারের দাম সমন্বয়ের পর এই স্বয়ক্রিয় মুনাফা আর পাবেন না শেয়ারধারীরা। তবে বিএসইসি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় এই কোম্পানিতে যারা নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। কারণ ফ্লোর প্রাইস ৯০৭ টাকা ৬০ পয়সার নিচে নামবে না ভেবে উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনেছেন বহুজন। বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭৯৯ টাকায়। তবে এরপর ফ্লোর প্রাইসের বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলে দাম কমে যায় প্রায় আড়াইশ টাকা।

সোমবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির দাম দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৫৪ টাকা ৭০ পয়সা। ফ্লোর প্রাইসের কারণে পতনমুখি বাজারে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষা হচ্ছে সত্য, তবে এই দাম যে বিনিয়োগকারীদের কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না, সেটিও স্পষ্ট। ৮০টিরও বেশি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে কেনাবেচা হচ্ছে খুবই কম। বিক্রয়ের অর্ডার দিলেও এই দামে কিনছে না বিনিয়োগকারীরা।

ফ্লোর প্রাইস নিয়ে এই জগাখিচুরি অবস্থার বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘ যে দুটির দাম পরিবর্তন হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে বিএসইসি সিদ্ধান্ত নেবে কী করবে। তবে আমরা মনে করি, বর্তমান যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি ফ্লোর প্রাইসের নীতিমালার বিরোধী হয়েছে। এখন যদি প্রভাবশালী গোষ্ঠী কম দামে শেয়ার কিনতে চায়, তাহলে তারা বিএটিবিসির শেয়ার পর ফেলে দেবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান হবে।’