দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিএনপি নেত্রী আফরোজা খান রিতার কোম্পানি মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন দুই বছর আগে মুন্নু সিরামিকের শেয়ার বিক্রি করে ৩৫ লাখ। বিক্রির ঘোষণা আসার আগে ৪০ টাকার শেয়ার বেড়ে হয় ৪৪১ টাকা। ফাউন্ডেশন শেয়ার বিক্রির পর তা আবার কমে আসে। দুই বছর আগে গ্রুপের শেয়ারে কারসাজি করে ১৩১ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের শেয়ার বিক্রির প্রমাণ মিলেছে মুন্নু সিরামিকস ও মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে।

মোট ৩৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করা হয় সে সময় অভিহিত মূল্যে যার দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির লাভ হয়েছে ১২৮ টাকার মতো। দাম বাড়ানোর আগে যদিও প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪০ টাকার মতো। এই হিসাব করা হলে কোম্পানির লাভ হয়েছে ১০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তদন্তে বের হয়ে এসেছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপনে ফাঁস করে, হিসাব বাড়িয়ে দেখিয়ে কারসাজি করে মুন্নুর দুটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হয় সে সময়। ওই বছরে ৪০ টাকার মুন্নু সিরামিকের দাম কারণ ছাড়াই বেড়ে হয় ৪৪১ টাকা। সেই দাম এখন কমে হয়েছে ১২৬ টাকা। সেটি আরও কম হতে পারত। মূল্য পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি যে প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেধে দিয়েছে, সেই দামই এটি। সে সময় যারা এ কোম্পানির শেয়ারের কিনেছিলেন তাদের শেয়ার প্রতি লোকসান এখন তিনশ টাকার বেশি।

দুই বছরের তদন্ত শেষে ফাউন্ডেশনকে ১০ কোটি টাকা আর মুন্নু সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সমস্ত পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালক বাদে) ১ কোটি টাকা করে জরিমানা করেছে বিএসইসি। অর্থাৎ মোট জরিমানা ১৫ কোটি টাকা। বিএনপি নেত্রী আফরোজা খান রিতা এই কোম্পানিটির মালিক। তিনি বিএনপির সাবেক মন্ত্রী হারুনার রশীদ খান মুন্নুর মেয়ে। কারসাজি করে লাভ করেছে শত কোটি টাকা, আর জরিমানা ১৫ কোটি এভাবে শাস্তি দিলে কোনো লাভ হবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘মুন্নু সিরামিকের যে কারসাজি সেটা আরও আগেই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত ছিল। তারা যেভাবে শেয়ার বিক্রি করেছে সেটা অন্যায়। এখন বর্তমান কমিশন যেহেতু বিষয়টি আমলে নিয়ে তাদের শাস্তির আওতায় এসেছে, সেটাও একটা ভালো দিক।’
আবু আহমেদের পরামর্শ, যে কোম্পানির কিছুই নেই, বছরে ভালো লভ্যাংশ দিতে পারে না, সেই কোম্পানির শেয়ার কেন চারশ টাকায় কিনবে। এ ধরনের কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরও সচেতন হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘এক কথায় তাদের শূলে চড়ানো উচিত। পুঁজিবাজারকে তারা তাদের নিজেদের সম্পত্তি মনে করে। এসব কোম্পানির উদ্দেশ্যই হচ্ছে লুটপাট করা। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা লুট করতে যে সময় লাগে পুঁজিবাজারে তার চেয়ে সহজে লুট করা যায়।

তিনি বলেন, ‘তাদের কারসাজির দুই বছর পর শাস্তি দেয়া হলেও আমি মনে করি এতে অন্যান্য কোম্পানির জন্যও শিক্ষণীয় হবে।’ বিএসইসি থেকে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী যতটুকু করা যায়, ততটুকুই শাস্তি দেয়া হয়েছে। সে সময় একই কোম্পানির মালিকানাধীন আরেক কোম্পানি মুন্নু স্টাফলারের দাম ৩৫০ টাকা থেকে বেড়ে সে সময় হয় পাঁচ হাজার ৮০০ টাকায়। এই কোম্পানিটি পড়ে প্রতি দুটি শেয়ারের বিপরীতে তিনটি বোনাস শেয়ার দেয়। কিন্তু দর ধরে রাখতে পারেনি। এখন শেয়ারটির দাম ৭৯৪ টাকা। এটিও বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন ফ্লোর প্রাইসে আছে।

যেভাবে শেয়ার বিক্রি: দাম সর্বোচ্চ পরিমাণে বাড়ার পর মুন্নু সিরামিকের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয় মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।
২০১৯ সালের ৪ মার্চ ঘোষণা আসে মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের করপোরেট ডিরেক্টর মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন তাদের কাছে থাকা মুন্নু সিরামিকের এক কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৩৩০টি শেয়ার থেকে সাত লাখ শেয়ার পাবলিক মার্কেটে বাজার দরে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিক্রি করা হবে।

তার ৫ কার্যদিবসে বিক্রি হয়ে যায় ৭ লাখ শেয়ার। এই সময়ে অর্থাৎ ৪ মার্চ কোম্পানির শেয়ারে সর্বোচ্চ দর ছিল ৪৪১ টাকা। এটাই মুন্নু সিরামিকের গত দুই বছরের সর্বোচ্চ দর। তার একদিন পর ৫ মার্চ শেয়ার প্রতি দর ছিল ৪৩০ টাকা। ৬ তারিখে দর হয়ে ৪১৭ টাকা। আর ৭ মার্চ দর কমে হয় ৩৮৮ টাকা।

৮ ও ৯ মার্চ সরকারি ছুটি থাকায় লেনদেন হয়ে ১০ মার্চ। সেদিন ৪১০ টাকা ২০ পয়সা। এ সময় কোম্পানিটির গড় দর ছিল ৪১৭ টাকা। এই হিসাবে সাত লাখ শেয়ার বিক্রি করা হয় ২৯ কোটি ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। ১১ মার্চ আবারও ঘোষণা করা হয় মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ২৮ লাখ শেয়ার বিক্রি করবে হাতে থাকা এক কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৩৩০টি শেয়ারের মধ্যে। সেদিন সর্বোচ্চ দর ছিল ৩৬৯ টাকা ১০ পয়সা। এভাবে ২৮ লাখ শেয়ারের দাম আসে ১০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

অর্থাৎ মুন্নু সিরামিকের ৩৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করে ১৩১ কোটি টাকার মতো আয় করে মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। লেনদেনের হিসাবেও দেখা গেছে, ৪ মার্চ মুন্নু সিরামিকের মোট লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি ২১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৯ টি। আর ৫ মার্চ লেনদেন হয়েছে নয় লাখ ৪৪ হাজার ৭৯১টি। ছয় মার্চ লেনদেন হয়েছে সাত লাখ ৯২ হাজার ৬১৭টি। এই কোম্পানির আহামরি কোনো লভ্যাংশ দেয়ার ইতিহাস নেই। কোম্পানিটি ২০১৭ সালে ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ বোনাস আর ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করে। বিএসইসির তদন্তে বের হয়ে এসেছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপনে ফাঁস করে, হিসাব বাড়িয়ে দেখিয়ে কারসাজি করে মুন্নুর দুটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হয়েছিল। ছবি: নিউজবাংলা

কী বলছেন কোম্পানি সচিব: এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানির সচিব নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, যেখানে মুন্নুর সিংহভাগ শেয়ার রয়েছে। সাত লাখ শেয়ার পাবলিক মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছে।

তবে পরবর্তীতে যে ২৮ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তার পুরোটি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা যা করেছি বিএসইসিকে জানিয়ে করেছি।’ বিএসইসি জরিমানার সিদ্ধান্ত নিলেও সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে মনে করেন মুন্নুর কোম্পানি সচিব। বলেন, ‘২৮ লাখ শেয়ার ব্লক মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছে। ফলে এখানে কারসাজি বা অন্যায়ের কী হয়েছে তা বোধগম্য নয়।’

অনিয়মের প্রমাণ বিএসইসির তদন্তে: কোম্পানিটি শেয়ার লেনদেনে কারসাজিসহ করপোরেট ডিক্লারেশনের অনিয়ম করেছে তার প্রমাণ পায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি।

এজন্য কোম্পানির করপোরেট উদ্যোক্তা মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন শেয়ার বিক্রির তথ্য পর্যালোচনা করে মুন্নু সিরামিক, ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। তারই অংশ হিসাবে প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটিকে পাবলিক মার্কেট থেকে সরিয়ে স্পট মার্কেটে-নগদ বা ক্রয়যোগ্য টাকায় লেনদেনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যা ২০২০ সালের ২০ মার্চ স্পট মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে নিয়ে আসা হয়।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম জরিমানার প্রসঙ্গে বলেন, ‘কোম্পানিটি মূলত ২০১৯ সালে শেয়ার বিক্রি করে অনিময় করেছে। যার সঙ্গে কোম্পানির পরিচালকরা সম্পৃক্ত ছিল। তারই প্রেক্ষিতে কোম্পাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহ প্রত্যেক পরিচালককে–স্বতন্ত্র পরিচালক বাদে এক কোটি টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।’

মুন্নু সিরামিকসের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা খান। উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক রশিদ মায়মুনুল ইসলাম ও হুরুন নাহার রশিদ। বাকি দুজন মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মনোনীত পরিচালক রশিদ সামিউল ইসলাম ও রশিদ রাফিউল ইসলাম। সুত্র: নিউজবাংলা