দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানির শেয়ার কিনলেই দ্বিগুণ লাভ এমন একটা চিত্র দাঁড় করিয়ে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের ২-৫ দিন হাতে থাকা পুরাতন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। আর সেই শেয়ার বিক্রির চাপে দরপতন হচ্ছে। এরপর নতুন কোম্পানির তালিভুক্তির দিন কিংবা তার পর দিন থেকে আবারও পুঁজিবাজারে উত্থান হচ্ছে, সূচকও বাড়ছে। শেয়ার বাজার পর্যবেক্ষণে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে নতুন কোম্পানির শেয়ার। একশ্রেণির বিনিয়োগকারী কোনো বাছবিচার ছাড়াই শুরুতে অতিমূল্যায়িত করে ফেলছে এসব শেয়ার। যে কারণে দ্রুত শেয়ারগুলোর মূল্য আয় অনুপাত বা পিই-রেশিও বেড়ে যাচ্ছে, যা পুঁজিবাজার এবং বিনিয়োগকারী উভয়ের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ মঙ্গলবার দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ই-জেনারেশন লিমিটেড। প্রযুক্তিখাতের এই কোম্পানিকে কেন্দ্র করে টানা পাঁচদিন দরপতন হয়েছে।

সুত্র, মতে, অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়ে বুক বিল্ডিং এবং ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে মোট ১০ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের ২-৫ দিন পর্যন্ত দরপতন হয়েছে। আর তালিকাভুক্তির দিন অথবা তারপর দিন থেকে আবারও পুঁজিবাজারে উত্থান হচ্ছে। সূচক লেনদেন ও বেশির ভাগ কোম্পানির দাম বেড়েছে। লেনদেনের প্রথমদিনগুলোতে এই কোম্পানির শেয়ারগুলোতে ক্রেতার পরিমাণ এতো বেশি থাকে, যে বিক্রেতার অভাবে হল্টেড হচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভিল্যান্সে টিমও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আসা কোম্পানি হলো- মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এডিএন টেলিকম লিমিটেড। আর ফিক্সডপ্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে- তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, রবি আজিয়াটা লিমিটেড, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন লিমিটেড, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স এবং ডমিনেজ স্টিল সিস্টেমস লিমিটেড।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে তালিকাভুক্ত নতুন কোম্পানি রবি আজিয়াটার শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত ১৩৩ দশমিক ৯৮। একইভাবে বাজারে নতুন আসা কোম্পানি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত প্রায় ২৭। যদিও এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত ৪০-এর উপরে ছিল। কিন্তু তালিকাভুক্তির কিছুদিনের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্যহারে শেয়ারদর পতন হওয়ার কারণ পিই-রেশিও কমে গেছে।

সম্প্রতি এই দুই কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরপরই অতিমূল্যায়িত হয়ে যায়। আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদরই অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পায়। না বুঝে দুটি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের প্রতিযোগিতায় নামেন বিনিয়োগকারীরা। যে কারণে অল্প সময়ের মধ্যে রবির শেয়ার ৭৭ টাকা ১০ পয়সা এবং এনার্জিপ্যাকের শেয়ার ১০১ টাকার ওপরে চলে যায়। পরবর্তীতে আবার টানা দরপতন শুরু হয় এ দুটি কোম্পানির শেয়ারের। সর্বনিন্ম রবির শেয়ার ৩৭ টাকা এবং এনার্জি পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের শেয়ার ৪৬ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়।

বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানি নতুন হোক আর পুরোনো হোক এখানে বিনিয়োগের আগে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নিতে হবে। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো না হলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ঠিক না। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পিই-রেশিওর দিকে নজর রাখা দরকার। এটা যত কম হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে ঝুঁকি তত কম হবে।

একই জানতে চাইলে বিএসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাজারে নতুন আসা এ দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারই বাজারে আসার পর অতিমূল্যায়িত হয়ে যায়। এটা করেছেন বিনিয়োগকারীরা। সে কারণে এখন তাদের মাশুল গুনতে হচ্ছে। তবে বিষয়টিকে ভিন্ন মত পোষণ করেন কেউ কেউ। তারা মনে করেন নতুন কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীদের এই শেয়ারের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। কারণ তাদের ধারণা থাকে এসব কোম্পানি থেকে ভালো রিটার্ন পাওয়া যাবে। সেই আশাতে শেয়ারদর বাড়তে থাকে। কারণ আগে রিটার্ন না দেয়ায় নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান শেয়ারহোল্ডারদের কতটা তুষ্ট করতে পারবে তা বোঝার উপায় থাকে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নতুন কমিশনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বীমা খাতের কোম্পানি এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট তালিকাভুক্ত হয়। ঠিক তার আগের তিন কার্যদিবস অর্থাৎ ১৯, ২০ এবং ২৩ আগস্ট দরপতন হয়। এই দরপতনের ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স চার হাজার ৭৯০ পয়েন্ট থেকে ২৮ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৭৬২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। তার পরদিন থেকে আবার পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে।

প্রায় একমাস পরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে গতবছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তালিকাভুক্ত হয় ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রজ। এই কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের পাঁচদিন দরপতন হয়েছে। তাতে সূচক ৩৮ পয়েন্ট কমেছে। আর তালিকাভুক্তির পর থেকে শেয়ারগুলোর দামও বেড়েছে। আবার পুঁজিবাজারে উত্থানও হয়েছে।

একইভাবে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স ২১ ডিসেম্বর তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ১৫ থেকে ২০ ডিসেম্বর টানা ৫ কার্যদিবস দরপতন হয়েছে। এরপর টানা উত্থান হয়েছে। তার দুই মাস আগে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন লিমিটেড। এই কোম্পানিটির তালিকাভুক্তির আগের টানা চারদিন দরপতন হয়েছে। এছাড়াও তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লেনদেন শুরুর আগে দরপতন হয়েছে। লেনদেন শুরুর পর থেকে আবার পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে।

অন্যদিকে বুক বিল্ডিংয়ে তালিকাভুক্ত হওয়া মীর আক্তার তালিকাভুক্ত হয় গত ২ ফেব্রুয়ারি। তালিকাভুক্তির আগের তিন কার্যদিবস পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। লেনদেন শুরুর পর আবার উত্থান হয়েছে। একইভাবে ১৯ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাকের তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের দিন দরপতন হয়েছে। আর চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি এডিএন টেলিকমের তালিকাভুক্ত হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি দরপতন হয়েছে। তবে বিপরীত চিত্র ছিল ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস লিমিটেড এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেডের সময়।