দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) গতকাল শুক্রবার রাতে পাঁচ দিনের বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করেছে। সিডিপির এলডিসি–সংক্রান্ত উপ–গ্রুপের প্রধান টেফেরি টেসফাসো গত রাতে এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে বের হতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ তুলনামূলক দুর্বল, সেসব দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে পাঁচ বছর পর এলডিসি থেকে বের হয়ে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাবে বাংলাদেশ।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটে উন্নয়নশীল দেশের কাতারভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় মূল্যায়ন শেষে শুক্রবার রাতে এ ঘোষণা দেয়া হয়।

সিডিপির সুপারিশের পর সবকিছু ঠিক থাকলে পাঁচ বছর পর উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত হবে বাংলাদেশ। প্রস্তুতি পর্বে বাংলাদেশের কী করা উচিত, চ্যালেঞ্জসমূহ কী সব বিষয়ে কথা বলেছে শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য অনন্য অর্জন। এতে আরও উজ্জ্বল হবে দেশের ভাবমূর্তি, এই অর্জন বড় ভূমিকা রাখবে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে।

পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ)। ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নতুনভাবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে এই অর্জন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হওয়া আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের রেটিং বাড়বে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনা সহজ হবে।’ টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আনোয়ার পারভেজ একাধারে ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান।

দেশের গার্মেন্টস শিল্প এখনও অনেক দেশ থেকে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে। উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনে বিদ্যমান সুবিধা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হলে সমাধান কী হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ায় আমাদের অনেক সুযোগসুবিধা এখন ছাড় দিতে হবে। এ জন্য আমরা যেসব দেশ থেকে কোটামুক্ত, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিলাম, সেসব দেশের সঙ্গে দ্রুত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। আমাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে।’

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এলডিসি থেকে আগেই বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হলো। আরও আগে স্বীকৃতি পেলে বেশি খুশি হতাম।’ তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘটনা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। তবে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। গরিব দেশগুলোকে সহজ শর্ত ও কম সুদে ঋণ দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা। এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

‘অবশ্য এখন আর বাংলাদেশকে গরিব দেশ হিসেবে দেখে না দাতারা। ২০১৬ সাল থেকে মিশ্রিত দেশ (ব্লেনডেড) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নমনীয় ঋণ এবং কিছু ক্ষেত্র বাজারভিত্তিক ঋণ দেয় তারা।’ ঋণ পরিশোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যে ধরনের সক্ষমতা থাকা দরকার, বাংলাদেশের তা আছে বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, ‘ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সস্তা ঋণ সুবিধা বাতিল হলেও তেমন অসুবিধা হবে না। ‘আমরা অত গরিব নই, যতটা ভাবা হয়। সক্ষমতা বাড়ছে। আরও বাড়াতে হবে। আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা হতে পারে বাজার সুবিধা নিয়ে। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। তখন বিশ্ব বাজারে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।’

তিনি বলেন, প্রস্তুতি পর্বে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় রয়েছে, তাই এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। সময় বাড়িয়ে প্রস্তুতি না নিয়ে ঘুমালে কোনো লাভ হবে না। শিল্পকারখানার দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।’
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বল্পান্নত দেশ-এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের মার্যাদা বাড়াবে। দেশের ভাবমূর্তি ব্র্যান্ডিংয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রবাসে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তাদের জন্যও এ অর্জন সহায়ক হবে। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই পেতে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যারা বিনিয়োগ করতে চান বা বিদেশে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী তাদের কাছেও ইতিবাচক বার্তা যাবে। তবে উন্নয়নশীল দেশে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশকে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলেও মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজেটে যেসব খাতে ভর্তুকি সুবিধা দেয়া হয়, তা আর থাকবে না। কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় পণ্য রপ্তানির সুবিধা থাকবে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্ব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। দেশীয় পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এত দিন যে প্রতিযোগিতার মধ্যে ছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে নতুন প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অনেক চ্যালেঞ্জ সামাল দেয়া যাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণকে দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাইলফলক বলে মনে করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘এত দিন বাংলাদেশকে উদীয়মান ও বিকাশমান শক্তি হিসেবে আকার-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে। এবার সেটার বাস্তব প্রতিফলন ঘটল।’

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কৃষি, সেবা, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সে অগ্রগতি- সব মিলিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছিল। জাতিসংঘের ঘোষণার মাধ্যমে তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘উত্তরণের ফলে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শক্তিশালী অবস্থান রাখার সুযোগ অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। সে কারণে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, রপ্তানি, সেবা খাতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখা গেছে। ‘প্রস্তুতি পর্বে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

বিশেষ করে আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানি ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ওষুধ খাতের পেটেন্ট সুবিধা যাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকে সে বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।’

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকগুলো উপাদান থাকে। ব্যবসার পরিবেশকে উপযুক্ত করার জন্য সরকারের অনেক নীতি থাকে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হলে এসব নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।’

এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেকগুলো সমস্যা তৈরি হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এগুলো সমাধানে ভূমিকা নিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসহ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’ শামস মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে, কিন্তু গত তিন বছর ধরে একটা পণ্যের যে দর থাকে সেটা কমছে।

এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে যেসব ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যেত সেগুলো আর থাকবে না।’ রাজস্ব বিভাগে সংস্কারে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘তা না হলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে না। সরকার যেসব বিনয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।’