ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: সপ্তাহখানেক আগে ভারতীয় হাইকমিশনের ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম, কারণ হাইকমিশন থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। সংগত কারণেই সম্মতি জানাতে আমার সময় লেগেছিল কয়েক সেকেন্ড হলেও বেশি। তার মানে অবশ্য এই না যে এই আমন্ত্রণটি গ্রহণে আমার ন্যূনতম দ্বিধা ছিল।

আমি বরং দারুণভাবে অবাক হয়েছিলাম যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এবং সেই দেশটিও আবার ভারত যে ভারতের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বাঙালি শহীদদের রক্তের মিলিত স্রোতোধারায় আজ থেকে ঠিক ৫০টি বছর আগে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। গুটিকয়েক অদ্ভুতুড়ে মানুষকে বাদ দিলে, গোটা বাঙালি জাতি আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে ব্যস্ত আর সেই উদযাপনে শরিক হতেই ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আগমন।

যেকোনো ভিভিআইপির সঙ্গে সাক্ষাতের বেলায়ই যেমনটি হয়ে থাকে, অর্থাৎ সাক্ষাতের চেয়ে প্রতীক্ষার পর্বটি দীর্ঘতর হয়। এ ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা যে যার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিভিআইপির আগমনের অপেক্ষায়। নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত, তাদের হঠাৎ চাঞ্চল্যই বলে দেয় কখন ভিভিআইপির পদার্পণ ঘটতে যাচ্ছে। এবারও হলো তাই-ই। নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে আমি আমার মতো করে একটা অবয়ব চিন্তা করে রেখেছিলাম। আমার কখনোই ধারণা ছিল না যে তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ ঘটতে পারে, বিশেষ করে এই করোনাকালে তো না-ই।

আমার ধারায় নরেন্দ্র মোদি একজন ক্যারিসমেটিক রাজনীতিবিদ, যিনি আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাঁর প্রভাববলয় সংহত করায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমার এই ধারণাটি একেবারে দুমড়েমুচড়ে গেছে। দুই হাত প্রসারিত করে ঋষিসদৃশ মানুষটির প্যান-প্যাসিফিক ঢাকার নির্দিষ্ট কক্ষে নাটকীয় প্রবেশ আর মুহূর্তেই তাঁর গোটা উপস্থিতিকে জয় করে নেওয়া।

ওই রুমটিতে সেই মুহূর্তে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই একাত্তরের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ব্যতিক্রম শুধু সহধর্মিণী অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী আর আমি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিটি উচ্চারণে আর উচ্চারণের প্রগাঢ়তা ও গভীরতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর অতল শ্রদ্ধার অশেষ পরিচয়ে আপ্লুত আমি!

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের মান্যবর হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সহধর্মিণী অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরীকে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরীর কন্যা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, তখন আমার মতো উপস্থিত অন্যরাও বিস্ময়াবিভূত যে তিনি নুজহাতকে মনে রেখেছেন কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার জন্য। সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুজহাতকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শহীদকন্যা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি যে নুজহাতকে এভাবে মনে রাখবেন এমনটা ভাবাই কঠিন। আমার বুঝতে আর বাকি থাকে না কিভাবে এই ব্যক্তিটি গোটা ভারতবর্ষকে জিতে নিলেন!

আমাদের সাক্ষাৎপর্ব যখন শেষ, ঘর থেকে প্রস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পাই। আর প্রথম যে চিন্তাটি মাথায় আসে, ‘আচ্ছা, কি পোশাক পরেছিলেন তিনি? চোখে কি চশমা ছিল?’ বুঝতে পারি একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার মেইডেন সাক্ষাৎপর্বটি, আর একটা গভীর উপলব্ধিও হলো একই সঙ্গে।বুঝতে পারলাম এইমাত্র আমার সঙ্গে ‘ইতিহাসের’ সাক্ষাৎ হলো, কারণ এই ভদ্রলোক এসেছেন ইতিহাসকে ঢেলে সাজাতে, এসেছেন ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গাটায় ঠিকঠাকমতো পৌঁছে দিতে।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ