দেশ প্রতিক্ষণ, চট্টগ্রাম: কক্সবাজার ও বান্দরবানের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বানাতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করতো দুই দালাল নজিবুল্লাহ ও নুরুল আবছার। সম্পর্কে ঘনিষ্ট বন্ধু এই দুইজন মিলে রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনের অসাধু কর্মচারীদের মাধ্যমে এনআইডি বানিয়ে দিত। এই এনআইডি দিয়ে পাসপোর্ট বানানো হতো। আর পাসপোর্ট বানানোসহ বিদেশে পাঠাতে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করার কাজটি করতো মেরীগুড ট্রাভেল এজেন্সি। কাজির দেউড়ি ভিআইপি টাওয়ারের দ্বিতীয় তলার ট্রাভেল এজেন্সিটির মালিক জনৈক মোহাম্মদ রফিক।

এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরপরই সেই ট্রাভেল এজেন্সি স্থান পরিবর্তন করে একপ্রকার আড়ালে চলে যায় রফিক। দালাল নুরুল আবছার ট্রাভেল এজেন্সি মালিক রফিকের মেয়ের জামাই। অর্থ্যাৎ শ্বশুর-জামাই সিন্ডিকেট মিলেই এনআইডি জালিয়াতি কাজে জড়িত ছিল।

ইতোমধ্যে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন আসামির কাছ থেকে এমন তথ্য মিলেছে। সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন দালাল নজিবুল্লাহ। সেও গত বৃহস্পতিবার মহানগর হাকিম শফি উদ্দিনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ পর্যন্ত এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মধ্যে ছয়জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সঞ্জয় সিনহা বলেন, ‘নজিবুল্লাহ ছিল রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরি করার দালাল। সে বিভিন্ন জায়গা থেকে রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী জয়নালের মাধ্যমে এনআইডি বানাতো। ইতোমধ্যে জয়নালসহ তিনজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নজিবুল্লাহর নাম এসেছে। তাকে নাইক্ষ্যংছড়ির নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নজিবুল্লাহর কাছ থেকেও কিছু তথ্য পেয়েছি। এছাড়াও যাদের নাম আসছে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে। নজিবুল্লাহর একজন সহযোগীকেও আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছি।’

সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের দিকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার মিশনে নামে চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের অসাধু কর্মচারীরা। সেসময় বন্দর নির্বাচন অফিসের খায়ের ও আনোয়ারের সাথে দালাল নজিবুল্লাহ ও নুরুল আবছারের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। ইসির দুই কর্মচারী বন্দর অফিসের সার্ভারের মাধ্যমে নিয়মিত ইসির প্রধান সার্ভারে ডাটা আপলোড দিত। আর ভোটার করতে এসব রোহিঙ্গাদের যোগান দিত নজিবুল্লাহ ও আবছার। হঠাৎ ইসি কর্মচারী খায়ের ও আনোয়ার বদলি হয়ে গেলে আর্থিক লেনদেন নিয়ে দুই দালালের সাথে তাদের ঝামেলা বাঁধে।

সুযোগটি কাজে লাগায় ডবলমুরিং অফিসের জয়নাল। খায়ের ও আনোয়ারের কাছে থাকা নজিবুল্লাহ ও আবছারের কিছু রোহিঙ্গার এনআইডি জয়নালের মাধ্যমে আউটসোসিং কর্মচারী ফারুক আডলোড দিত। বিষয়টি জানাজানি হলে দালাল নজিবুল্লাহ ও নুরুল আবছার সরাসরি জয়নালের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতি করতো। অধিকাংশ সময় এসব লেনদেন হতো ভিআইপি টাওয়ারের রফিকের ট্রাভেল এজেন্সিতে। তখন বেটারি গলি এলাকায় বসবাস করতো দালাল নজিবুল্লাহ। নজিবুল্লাহ নাইক্ষ্যংছড়িতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত ছিল।

এদিকে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি জালিয়াতির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া এক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে তৎকালীন পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখের নাম। জবানবন্দিতে বলা হয়, এই কর্মকর্তার মাধ্যমে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক ও পাঁচলাইশ নির্বাচন অফিসের তৎকালীন অফিস সহায়ক নাজিম উদ্দিন নিয়মিত এনআইডি বানাতো। যার বিনিময়ে ইসি কর্মকর্তা লতিফ শেখ জনপ্রতি পেতো পাঁচ হাজার টাকা। বর্তমানে জেলা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া লতিফ শেখ অন্যত্র বদলি হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামিনে আসা দুইজন আসামি জানান, ‘ছোট কর্মচারীদের ফাঁসিয়ে দিয়ে বড় কর্মকর্তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের বড় একটি সিন্ডিকেট এই কারসাজির সাথে জড়িত। যার মধ্যে কর্মকর্তা পর্যায়ের লোকজনও আছে।’

এদিকে ভিআইপি টাওয়ারের সেই ট্রাভেল এজেন্সিতে গিয়ে দেখা যায়, সেটি বন্ধ। দোকানের সামনে দেখা হলে এক ব্যক্তি জানান, ‘এই প্রতিষ্ঠানটি এখান থেকে সরে গেছে। এটি এখন রুবি গেটে তামান্না গার্মেন্টস এলাকায় চলে গেছে বলে জেনেছি।’

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট লাকী আকতার নামে এক রোহিঙ্গা নারী এনআইডি কার্ড তুলতে গেলে রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার বিষয়টি প্রথম জানাজানি হয়। এ ঘটনার পর থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এ ঘটনা নিয়ে জোর তৎপরতা শুরু করে।