পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা ফান্ডের বিনিয়োগ নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে মতবিরোধ!
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মধ্যে হঠাৎ মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠন ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই এই তহবিলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবণ্টিত মুনাফা নেওয়া যাবে না।
তবে বিএসইসি মনে করছে, এই তহবিলের মাধ্যমে পাওনাধারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি তা পুঁজিবাজারের উন্নয়নেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে আরও ব্যাখ্যা দিতেও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুঁজিবাজারের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
গত সোমবার সাতটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে এমন মতবিরোধ দেখা দেয়। অনলাইনে অনুষ্ঠিত গতকালের সমন্বয় সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসি ছাড়াও যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তর (আরজেএসসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (এমআরএ) ও সমবায় অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা অংশ নেন।
এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে গভর্নর ফজলে কবির, বিএসইসি কমিশনার শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ, বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারসহ সব সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয়ের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক তুললেও কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়েছে।
গত সোমবারের সমন্বয় সভায় এসইসি ক্যাপিটাল মার্কেট স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠনের ফলে উদ্ভূত জটিলতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা জানান, এই তহবিল ব্যাংক কোম্পানি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই তহবিলের বিধিমালা প্রয়োগ সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে এসইসি কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, যে নীতিটি করা হয়েছে, বিএসইসি সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত। ব্যাংক ১০ বছরের অদাবিকৃত মুনাফা বাজেয়াপ্ত করে নেয়, কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। বরং যারা প্রকৃত পাওনাধার তাদের পক্ষে আমরা এটি সংরক্ষণ করছি। পরবর্তীতে তারা পর্যাপ্ত প্রমাণ সাপেক্ষে পাওনা ফেরত পাবেন। এ ছাড়া এই তহবিল পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ব্যবহার হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।
ইতিমধ্যে অনেক ব্যাংক অবণ্টিত মুনাফা এই তহবিলে জমা করেছে। অবণ্টিত মুনাফা জমা নিতে কমিউনিটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় হিসাব খোলা হয়েছে। বিএসইসির ধারণা তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত মুনাফা বা অদাবিকৃত লভ্যাংশ নিয়ে যে তহবিল গঠন হচ্ছে, তার আকার ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে। এর মধ্যে নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, যার একটি অংশ শেয়ার কেনাবেচায় ব্যবহার হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ে তিনটি প্রস্তাব তোলা হয়। এর মধ্যে অবণ্টিত মুনাফা পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিলে জমা না দেওয়ার বাইরে পুঞ্জীভূত লোকসান থাকলে চলতি বছরের মুনাফা দিয়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ দেওয়ার বিষয়েও আপত্তি জানানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, পুঞ্জীভূত লোকসান বিদ্যমান থাকলেও চলতি বছরের মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ বিতরণ সংক্রান্ত এসইসির নোটিফিকেশনটি ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একই সঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক হিসাব রীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বিধায় তা ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা যাবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান।
একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে অন্যান্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ বন্ধ করার অনুরোধ জানায় তারা। তবে এসইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইএফআরএস অনুযায়ী পুঞ্জীভূত লোকসান থাকলেও চলতি বছরের মুনাফা থেকে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ দিতে পারে। এ ছাড়া এনবিআরের ১৯৯৪ সালের অর্ডিন্যান্সে নগদ লভ্যাংশে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর আগে সরকারের বাজেটেও নগদ লভ্যাংশ দিতে কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আরেকটি সিদ্ধান্ত হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক কোম্পানি আইন মেনে যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা পরিপালনে যেন এসইসির কোনো বিধি বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সম্প্রতি কোনো কোনো ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপত্তি তুলছে।
গত এক বছরেরও বেশি সময়ে সূচকের বড় ধরনের উল্লম্ফনকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসি মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। সূচকের উল্লম্ফনে প্রণোদনার অর্থ ভূমিকা রাখছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্দেহ পোষণ করে তদন্তের ঘোষণা দেয়।
তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্য পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক ও তার সাবসিডিয়ারির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের তথ্য প্রতিদিন চেয়ে পাঠিয়েছে আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। বিভিন্নভাবে চাপ তৈরি করে পুঁজিবাজারে প্রভাব রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সূচকের ৮০০০ পয়েন্ট পর্যন্ত মার্জিন ঋণের সর্বোচ্চ সুবিধা ঘোষণা করে বিএসইসি।