দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আরিফ খান। বর্তমানে সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান। মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনাকারী এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ছিলেন।

এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার হিসেবে। শেয়ারবাজারের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অনুলিখন করেছেন সুজয় মহাজন।

১. ঝুঁকি নিন, বুঝেশুনে: এক বছর আগেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ যতটা নিরাপদ ছিল, এখন ততটা নয়। কারণ, এ এক বছরে বাজারে সূচক ও শেয়ারের দামের বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। কিছু শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ থেকে চার গুণের বেশি হয়েছে। শেয়ারের দাম যত বেশি, বিনিয়োগের ঝুঁকিও তত বেশি।

এ কারণে এক বছর আগের তুলনায় বর্তমান বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কিছুটা বেশি। ঝুঁকি থাকার পরও এখনো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফার সুযোগ রয়েছে। সে জন্য ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি ভালোভাবে জেনেবুঝে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে।

বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হয়। এমনিতেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি বেশি বলেই এ বাজারে লাভের সম্ভাবনাও বেশি। লাভের সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ঝুঁকি নেওয়ার পাশাপাশি যতটা সম্ভব ঝুঁকি কমানোর কৌশলও জানতে হবে। শেয়ারবাজার ও যেখানে বিনিয়োগ করছেন, সে সম্পর্কে জানাবোঝা বা ধারণা না থাকলে পরিশ্রম ও চেষ্টা দিয়ে সেই কৌশল রপ্ত করতে হবে।

২. বিনিয়োগের লক্ষ্য চূড়ান্ত করুন: শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকে বিনিয়োগ হিসেবেই দেখতে হবে। বিনিয়োগ মানে প্রতিদিন মুনাফার আশা করা নয়। আমরা যখন ব্যাংকে বা অন্য কোথাও অর্থ বিনিয়োগ করি, তখন কিন্তু প্রতিদিন লাভের আশা করি না। আবার প্রতিদিন সেই বিনিয়োগের খোঁজখবরও নিই না। কিন্তু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বহুলাংশেই দেখা যায়, শেয়ার কেনার পরদিন থেকেই খোঁজখবর নিতে থাকি কত টাকা লাভ হলো। এটি কখনো বিনিয়োগের উদ্দেশ্য হতে পারে না।

তাই আমি মনে করি, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের আগে প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর উচিত বিনিয়োগের একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা। যেখানে থাকবে তিনি কত বছরের জন্য শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। সেই বিনিয়োগের বিপরীতে কত মুনাফা চান, কত দিনে চান, এসব হিসাবও বিনিয়োগের আগে করে নেওয়া ভালো। তাতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।

বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ও নিজের আর্থিক অবস্থাকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, একজন তরুণ ও পারিবারিকভাবে সচ্ছল বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে যতটা ঝুঁকি নিতে পারবেন, একজন সত্তরোর্ধ্ব ও পারিবারিকভাবে কম সচ্ছল ব্যক্তি ততটা ঝুঁকি নিতে পারবেন না। তাই বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগের লক্ষ্য চূড়ান্ত করুন বয়স, আর্থিক অবস্থা ও ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য বিবেচনায়।

৩. লোভ ও গুজব পরিহার করুন: শেয়ারবাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন লোভ ও গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে। অনেক সময় হয়তো গুজবে কান দিয়ে লাভবান হওয়া যায়। কিন্তু গুজবে বিনিয়োগ করে একবার, দুই বা তিনবারে যত লাভ হয়, চতুর্থবারে গিয়ে হয়তো তার চেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হয়।

আমরা যখন ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিই, তখন অনেকে নানা ধরনের মন্তব্য করেন। পাল্টা বলেন, গুজবে বিনিয়োগ করেই বেশি লাভবান হওয়া যায়। বেশির ভাগ সময় গুজবে খারাপ শেয়ারের দাম বাড়ে। দাম বাড়তে থাকলে অনেকে লাভবান হন। কিন্তু দাম যখন একবার কমতে শুরু করে, তখন ক্রেতাও পাওয়া যায় না। আবার অনেকে দাম বাড়তে থাকলে কেবলই বাড়বে, এই ভেবে শেয়ার বিক্রি করেন না। মুনাফার লোভে পড়ে শেষ পর্যন্ত অনেককে তাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

৪. আস্থা রাখুন দক্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপকে: আমাদের শেয়ারবাজারেও বেশ কিছু দক্ষ ও অভিজ্ঞ সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন একঝাঁক দক্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপক। শেয়ারবাজার সম্পর্কে যাঁদের জানাবোঝা কম বা জ্ঞান আহরণের সুযোগ সীমিত, তাঁরা নিজেরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত না নিয়ে সম্পদ ব্যবস্থাপকের ওপর আস্থা রাখতে পারেন।

অনেক সম্পদ ব্যবস্থাপক আছেন, যাঁদের হাতে আপনার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বাজারের যেকোনো সুদহারের চেয়ে বেশি হারে মুনাফা পাবেন। অসুখ হলে যেমন চিকিৎসকের পরামর্শ লাগে, তেমনি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগও একধরনের আর্থিক শৃঙ্খলা। যথাযথ নিয়ম না মানলে সেখানেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই না জেনে, না বুঝে যেখানে-সেখানে বিনিয়োগ করার বদলে দক্ষ ব্যবস্থাপকের পরামর্শ নিন।

৫. বিনিয়োগ করুন সঞ্চয়ের ৫০-৬০ শতাংশ: আপনি যদি নিজে নিজেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে শুরুতে কোনোভাবেই আপনার সঞ্চিত অর্থের পুরোটা এ বাজারে বিনিয়োগ করবেন না। সাধারণভাবে আমি বলব নিজে নিজে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের সর্বোচ্চ ৫০-৬০ শতাংশ বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

আবার যাঁরা অবসরভোগী বা যাঁদের বয়স বেশি, তাঁদের কোনোভাবেই সঞ্চয়ের ৩০-৪০ শতাংশের বেশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। আবার বাজারে বিনিয়োগ করা অর্থের অর্ধেক বিনিয়োগ করতে হবে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারে, যেখানে বছর শেষে ২০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে।

এ ছাড়া সব বয়সী বিনিয়োগকারীর নিরাপদ বিনিয়োগের আরেকটি সহজ উপায় হচ্ছে মাসে মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ (ডিপিএসের মতো) ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করা। তাতে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। সূত্র: প্রথম আলো