সিমেন্ট খাতের ৭ কোম্পানিতে মুনাফায় উস্ফল্লণ
তৌফিক ইসলাম ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনার সময়ে অন্যতম নির্মাণসামগ্রী সিমেন্ট খাত বেশ চাঙা ছিল। দেশে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে সিমেন্ট উৎপাদনে রেকর্ড করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারি হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে সিমেন্ট উৎপাদন প্রথমবারের মতো দুই কোটি টন ছাড়িয়েছে। বদৌলতে কোম্পানিগুলোর মুনাফাও বেড়েছে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাতটি সিমেন্ট কোম্পানিই আগের বছরের তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে। ফলে অন্যান্য খাতের তুলনায় সিমেন্ট খাতে মুনাফায় উস্ফল্লণ দেখা গেছে।
সিমেন্ট খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার মধ্যেও পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ সরকারি বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বেশ গতি পেয়েছে। তাই সিমেন্টের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। বেসরকারি খাতে সিমেন্টের চাহিদা কম থাকলেও, ব্যক্তিপর্যায়ে আবাসন খাত বেশ চাঙাভাবে রয়েছে।
এসব কারণেই মূলত করোনার সময়ে সিমেন্ট খাতটি যথেষ্ট ভালো করেছে। এখন দেশি-বিদেশি মিলিয়ে মোট ৩৫টি সিমেন্ট কোম্পানি উৎপাদনে আছে। পুঁজিবাজারের বাইরের কোম্পানিগুলোই সিমেন্টের বাজারে শীর্ষে আছে। তবে পুঁজিবাজার পুঁজিবাজারের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর সবই করোনার সময়ে কমবেশি ভালো করেছে।
পুঁজিবাজারে বর্তমানে সাতটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে লাফার্জ হোলসিম, হেইডেলবার্গ, ক্রাউন, কনফিডেন্স, আরামিট সিমেন্ট, মেঘনা সিমেন্ট ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট কোম্পানি। এসব কোম্পানির কোনোটির আয় বছর জুলাই-জুন; আবার কোনোটির আয় বছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর। সাতটি কোম্পানিই এখন লাভে আছে।
কোম্পানিগুলোর ঘোষিত তথ্যে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মুনাফায় আছে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট। চলতি ২০২১ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা দাঁড়ায় ২ টাকা ৬৬ পয়সা। এই কোম্পানির মোট শেয়ারসংখ্যা ১১৬ কোটি ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০। সেই হিসাবে, ওই ৯ মাসে মুনাফা হয় ৩০৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল দেড় শ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে লাফার্জের মুনাফা দ্বিগুণ হয়েছে।
মুনাফা অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে আছে কনফিডেন্স সিমেন্ট। গত জুন মাসে সমাপ্ত অর্থবছরে এই কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১৫ টাকা ৮৬ পয়সা। মুনাফার পরিমাণ ছিল ১২৪ কোটি টাকা। আগের বছর কোম্পানিটি মুনাফা করেছিল প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এর মানে, করোনার মধ্যেও কোম্পানিটি আড়াই গুণ মুনাফা করেছে।
তৃতীয় স্থানে আছে ক্রাউন সিমেন্ট। পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারসংখ্যা ১৪ কোটি ৮৫ লাখ। ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৫ টাকা ৭৯ পয়সা। আর পুরো অর্থবছরে এই কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৬ কোটি টাকা। অথচ আগের বছর কোম্পানিটি ১৩ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছিল।
এ ছাড়া হেইডেলবার্গ সিমেন্ট গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে সাড়ে ৫৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আর প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন সময়ে ৬৫ কোটি টাকা লাভ করেছে। আগের বছরে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া মেঘনা সিমেন্ট ও আরামিট সিমেন্ট এই সময়ে যথাক্রমে সাড়ে ৭ কোটি ও ২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সিমেন্ট খাত মোটামুটি ভালো করেছে। যতটা সমস্যা হবে বলে মনে করা হয়েছিল, ততটা হয়নি। শিল্পায়নে ধীরগতি থাকলেও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা দেখা গেছে, আর শহুরে এলাকায়ও ব্যক্তি খাতে প্রচুর আবাসন নির্মাণ হয়েছে।
এ ছাড়া সরকারি মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত চলেছে। তাঁর মতে, গত অর্থবছরে সরকারি খাতের তুলনায় বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে শিল্প খাতে সিমেন্টের চাহিদা কম ছিল। করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সিমেন্ট খাত মোটামুটি ভালো করেছে। যতটা সমস্যা হবে বলে মনে করা হয়েছিল, ততটা হয়নি বলে মন্তব্য করেন বিসিএমএ সভাপতি মো. আলমগীর কবির।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নিয়মিতভাবে শিল্পোৎপাদনের চিত্র প্রকাশ করে। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ২ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৯৭১ টন সিমেন্ট উৎপাদন করেছে। এটি এযাবৎকালের রেকর্ড। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিমেন্ট উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৭৯ লাখ ১৯ হাজার ১৬৪ টন।
করোনার মধ্যেও এক বছরে ৩১ লাখ টন বেশি সিমেন্ট উৎপাদিত হয়েছে। গত জুলাই-আগস্ট দুই মাসে ২৮ লাখ টনের মতো সিমেন্ট উৎপাদন করেছে কোম্পানিগুলো। ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর কঠোর বিধিনিষেধ বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তখন সরকারের বড় বড় প্রকল্প ও বেসরকারি খাতের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় সিমেন্ট কারখানাগুলোর উৎপাদন ৯০ শতাংশের মতো কমিয়ে দেওয়া হয়।
ওই বছরের জুন মাস থেকে ধীরে ধীরে সব খুলতে থাকে। সরকারি মেগা প্রকল্পগুলো আবার বাস্তবায়ন শুরু হয়। ফলে সিমেন্টের চাহিদা বাড়তে থাকে। সিমেন্ট কারখানাগুলোও উৎপাদন বাড়ানোয় মনোযোগ দেয়। সিমেন্ট উৎপাদন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও দুই-তিন মাস সময় লাগে। মূলত গত শীত মৌসুম থেকে সিমেন্ট খাত চাঙা হতে শুরু করে।