বিএনপিআমিনুল ইসলাম, মান্না আতোয়ার, ঢাকা: প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো দিন দিন ভেঙে পড়ছে।  দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা, সমন্বয়হীনতা এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের অসহযোগিতার কারণে চলমান আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে বিএনপিতে সংশয় দেখা দিয়েছে। এর ফলে দিন দিন কর্মীদের সাথে নেতাদের দুরুত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে নির্বাচন ঠেকানোর আশাও ছেড়ে দিয়েছে দলটি।

এ অবস্থায় খুব শিগগিরই আবার ভোট হবে উল্লেখ করে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের দলটির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে নির্বাচনের দিন বিএনপির শীর্ষ নেতারা মাঠে থাকবেন কিনা এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে নেতৃত্ব শুন্য থাকায় দিনদিন চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ছে। এ অবস্থায় দলের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত অবস্থায় তারেক রহমান। সম্প্রতি তারেক-মবিনের ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়েছে।

সূত্র জানায়, ভোটের আর মাত্র একদিন বাকি। ভোট প্রতিহত করার মতো কোনো পরিস্থিতি বিএনপি এখনো তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তবে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি আজ বার্তায় নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষনা দিয়েছেন।

বিএনপি সূত্র জানায়, একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে মাঠের রাজনীতি গরম করার ব্যাপারে আন্তরিক না হলেও কূটনীতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে বিএনপি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির কৌশলের কাছে পেরে ওঠেনি সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা এই দলটি।

শুধু কূটনীতিক পর্যায়ের চেষ্টা ক্ষমতাসীনদের বেকায়দায় ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিলো না বলে এখন উপলব্ধি করছেন দলটির হাইকমান্ড। নির্বাচন যেহেতু আর প্রতিহত করা সম্ভব নয়, সেজন্য নির্বাচনপরবর্তী সময়ে মাঠের আন্দোলনকেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

পাশাপাশি ৫ জানুযারির নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে না যেতে নেতাকর্মীদেরে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কর্মী-সমর্থকদের মুঠোফোনের ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে নির্বাচনের দিন করণীয় জানিয়ে দিচ্ছেন।

বার্তায় বলা হয়েছে, ‘বিএনপির নির্দেশ হলো- ভোটকেন্দ্রে নিজে না যাওয়া এবং নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বারণ করা। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই নৌকা, লাঙ্গল বা কলসিকে বিএনপি সমর্থন করে না। সবাইকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। অতি শিগগিরই ইনশা আল্লাহ নতুন ভোট হবে। তাই এই ভোট বর্জন করুন। আমাদের বিজয় ইনশা আল্লাহ হবেই।’

সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিয়েও শীর্ষ নেতারা মাঠে না থাকায় হতাশা বিরাজ করছে তৃণমূলে। এমনকি শীর্ষ নেতাদের বিশ্বাসও করতে পারছেন না দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ফলে আগের মতো সাড়া মিলছে না তাদের কাছ থেকে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বন্ধের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলছে এখন। কিন্তু এতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে তেমন সাড়া নেই।

কর্মসূচি ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকায় দায়সারাভাবেই চলছে এ কর্মসূচি। এর আগে দলটির ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতেও কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় আন্দোলন এগিয়ে নিতে দলের শীর্ষ নেতাদের দিকনির্দেশনা না পেয়ে কর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়েছে বলে দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সম্প্রতি প্রকাশিত ফোনালাপেও স্পষ্ট হয় চেইন অব কমান্ডের দুর্বলতার বিষয়টি। নভেম্বরের শেষ দিকে বিএনপির কর্মসূচি ও শীর্ষ নেতাদের অবস্থান প্রসঙ্গ ছিল ফোনালাপের বিষয়।

এ সময় দলের দুর্দিনে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আত্মগোপনে থাকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তারেক রহমান। এ সময় তিনি শমসের মবিনকে বলেন, ‘উনি (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) পালিয়ে থেকে লাভ কী হচ্ছে? বরং এতে কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে।’ বিএনপি ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেও বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে।

তারা জানান, আগে কর্মসূচি সফল করতে পূর্ব থেকেই নেতারা বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিকনির্দেশনা দিতেন। সে মোতাবেক কাজও করত কর্মীরা। বর্তমানে দলের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে থাকায় কর্মসূচি সফল করার দিকনির্দেশনা মিলছে না।

বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গিয়াস উদ্দিন মামুন জানান, ‘বর্তমানে দলের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে থাকার কারণে আমরা সঠিক দিকনির্দেশনা পাচ্ছি না। আবার সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ কারণে বুঝছি না আসলে কী করা উচিত।’

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে এর আগে সারা দেশে কমিটি গঠন করা হলেও তার কোনো কার্যকারিতা নেই। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করার পর নেতাশূন্য এখন দলটির কার্যালয়। বিএনপির বিভাগীয় ও জেলাপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও আন্দোলনে শীর্ষ নেতাদের কোনো ভূমিকা না থাকায় চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।

মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাসুদ অরুণ এ প্রসঙ্গে বলেন, চলমান আন্দোলনে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, দলের শীর্ষ নেতাদেরও সেভাবে সাড়া দিয়ে আন্দোলন সফল করা প্রয়োজন। এজন্য কেন্দ্রের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদেরকে কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান আজকের বাংলাদেশ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তৃণমূলে যেমন জনগণ মাঠে নেমে এসেছে, একইভাবে অচিরেই ঢাকায়ও জনগণ রাস্তায় নেমে আসবে। আন্দোলনের মুখে দাবি মানতে বাধ্য হবে সরকার। বিপুলসংখ্যক প্রশাসনিক বাহিনী মাঠে নামিয়ে আর বেশি দিন বিএনপির নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখতে পারবে না তারা।

তবে দলের মধ্যে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার বিষয়টি মানতে রাজি নন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের মতে, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করে রাজধানীতে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে।

কেন্দ্রীয় অফিসে পুলিশি তল্লাশি, নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, জামিন না দেয়া, দ্রুত বিচার আদালতে মামলাসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে সরকার। রাজধানীতে বিভিন্ন বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করে দলের কোনো কর্মসূচিতে কাউকে রাস্তায় নামতে দেয়া হচ্ছে না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু অভিযোগ করে আজকের বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান সরকার দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। সুষ্ঠু রাজনীতি করার মতো অবস্থা বর্তমানে দেশে নেই। নির্যাতনে বর্তমান সরকার ব্রিটিশ আমলকেও হার মানিয়েছে। সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে মাঠে নামতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। তবে এমন করে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। এর আগেও এভাবে নির্যাতন করে কোনো সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি।