কুমিল্লায় মনির হোসেন,কুমিল্লা: চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কুমিল্লার ১১টি আসনের মধ্যে ৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছে।

বাকী চারটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ায় সে সব আসনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। কুমিল্লার ৭টি আসনে ২১ লাখ ২৩ হাজার ৫৫৭ জন ভোটাধীকার অধিকাংশ ভোট প্রয়োগ করেনি।

৭ শ ৮১ টি ভোট কেন্দ্রে ৪ হাজার ২ শ ৬৬ টি ভোট কে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে সহিংসতার কারনে ৪টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে। কুয়াশার কারনে সকালে ভোটার উপস্থিতি হতাশা জনক থাকলেও কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে।

ভোট কেন্দ্র সমূহের নিরাপত্তায় ১১ হাজার ২ জন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর কুমিল্লার কোথাও তেমন কোন গোলযোগের খবর পাওয়া যায় নি।অপর দিকে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের বিনয় ঘোষ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১৮ দলীয় জোটের সমর্থকরা হামলা চালিয়ে ভোটসহ ৭ টি ব্যালেট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়।

এসময় তারা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে মারধর করে। পরে বিজিবি গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। দুপুর পৌনে ১২ টায় এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া মুরাদনগরে মটকিরচর স্কুল ভোটকেন্দ্রে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ছেলে আহসানুল আলম কিশোরের সমর্থকরা ব্যালেট পেপার ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এছাড়া দেবিদ্বারের রাজামেহার স্কুল কেন্দ্রে ব্যালেট বাক্স ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে উপজেলা সদর ইউনিয়নের মটকিরচর প্রাথমিক বিদ্যোলয়ের ভোট কেন্দ্রে আ’লীগের বিদ্রোহি প্রার্থী ইউছুফ আব্দুলা হারুনের সমর্থক সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আনারশ মার্কায় জোর করে ভোট দিতে চাইলে এলাকাবাসী বাধা দেয় এবং ভোট দিতে না পেড়ে বেলেয়ট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বর্তমানে ঐ কেন্দ্রে ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে।অপরদিকে পিপিরাকান্দা সরকারী প্রাথমীক বিদ্যালয়েও আনারশ সমথর্রা ব্যালট পেপারে আগুন দিয়েছে।

এর ফলে ঐ কেন্দ্রে ভোট নেওয়া বন্ধ রয়েছে।দুপুর ১টা পর্যন্ত  ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কম। অধিকাংশ কেন্দ্রেই ৮ ভাগেরও কম ভোট কাস্ট হয়েছে বলে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাগেছে।মুররাদনগর উপজেলা সহকারী রিটানিং অফিসার ও মুরাদনগর উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা আনিছুজ জামান খান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

এদিকে শনিবার রাতে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে ৭টি কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই করেছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তারা পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে এবং এক পুলিশ কনস্টেবলের অস্ত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এসময় আইনশৃংখলা বাহিনীর গুলিতে এক ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতিসহ ২ জন আহত হয়েছে। উপজেলার সরসপুর ইউনিয়নের ভাউপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্বাচনী ভোট কেন্দ্রে অন্তত ১০ টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃওরা।

এছাড়া হামলায় পুলিশ ও আনসারের ২ সদস্য আহত হয়। এ সব ঘটনায় মনোহরগঞ্জের ৪টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছেন কুমিল্লা জেলা রিটার্নিং অফিসার মো: তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলার সরসপুর ইউনিয়নের ভাউপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনিয়ে নেয় বিএনপি ও জামায়াতের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী।

এসময় তারা পর পর ১০ টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো এলাকায় আতংক ছড়িয়ে দেয়। শুরু হয় আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া। পরে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এতে সরসপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি সামছুর রহমান মানিকসহ অপর এক বিএনপি কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। তবে পুলিশের গুলির মুখে নির্বাচনের সকল সরঞ্জাম নিতে না পারলেও কয়েকটি ব্যালট বাক্স নিয়ে যায় বিএনপি ও জামায়াত কর্মীরা।

উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ মো. তৈয়ব হোসেন বলেন, আমরা একটি ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়ার খবর শুনেছি। তিনি বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আইশৃংখলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য পাঠানো হয়েছেএ বিষয়ে মনোহরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.হারুন-অর-রশিদ চৌধুরি বলেন, ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তিনি বলেন, হামলায় পুলিশ ও আনসারের ২ সদস্য আহত হয়েছে।

শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাইশগাঁও, হাওড়া স্কুল কেন্দ্রে পেট্্রল বোমা নিক্ষেপ করে ব্যালট পেপার ও নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া বিপুলাসারের ভোগৈ কেন্দ্রে ১০টি পেট্রল বোমা নিক্ষেপ, লক্ষনপুরের কান্দিরপাড় স্কুল কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাই ও পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই করেছে দুর্বৃত্তরা।এদিকে নির্বাচনের সময় কুমিল্লা সদর আসনে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসুদ পারভেজ খান ইমরানের সমর্থকদের সংঘর্ষ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এর আগে সকালে নগরীর হাউজিং এস্টেটের একটি কেন্দ্রে ও রঘুপুরে একটি কেন্দ্রে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে শিবির কর্মীরা। এতে কেউ হতাহত হয়নি। রবিবার সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত কুমিল্লার লাকসাম, দাউদকান্দি ও বুড়িচং উপজেলার বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে ভোটার সংখ্যা খুবি কম। তবে নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা বলছেন শীতের সকাল হওয়ার কারনে ভোটার কম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটার বাড়বে বলে জানান তারা।
এদিকে কুমিল্লার ৭টি আসনে যারা নির্বাচনে  প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করছেন,কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি) আসনে মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভূইয়া (আওয়ামীলীগ), আবু জাহের আল মাহমুদ (জাতীয় পার্টি), নাঈম হাসান (স্বতন্ত্র), বাসুদেব সাহা (স্বতন্ত্র) ও জামাল সরকার (স্বতন্ত্র)। কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনে মো: আক্তার হোসেন (জাতীয় পার্টি), ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (স্বতন্ত্র), আসহানুল আলম কিশোর (স্বতন্ত্র)।

কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনে মো: ইকবাল হোসেন (জাতীয় পার্টি), রোশন আলী (স্বতন্ত্র), রাজি মো: ফখরুল (স্বতন্ত্র)। কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) আসনে আবদুল মতিন খসরু (আওয়ামীলীগ), সফিকুর রহমান (জাতীয় পার্টি)। কুমিল্লা-৬ (সদর) আসন হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার (আওয়ামীলীগ), মাসুদ পারভেজ খান ইমরান (স্বতন্ত্র), মোহাম্মদ আলী ফারুক (ন্যাপ)। কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) নুরুল ইসলাম মিলন (জাতীয় পার্টি), এ এস এম কামরুল ইসলাম (স্বতন্ত্র)। কুমিল্লা-৯ (লাকসাম মনোহরগঞ্জ) আসনে মো: তাজুল ইসলাম (আওয়ামীলীগ), অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা (জাতীয় পার্টি)।
এদিকে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) আসনে এবার মোট ভোটার ৩ লাখ ৮ হাজার ২শ’ ৩২জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮শ’ ৩৮ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩শ’ ৯৪ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১শ’ ২৮টি এবং ভোট কক্ষ ৬ শ’ ৮৭টি। নতুন ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১২ টি।কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৩২ হাজার ৬শ’ ৫২ জন। এখানে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৩ হাজার ২শ’ ৩৮ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪ শত ১৪ জন। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১ শ’ ৩০ টি এবং ভোট কক্ষ থাকবে ৬ শ’ ১ টি। নতুন ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৬ টি।
কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের মোট ভোটার ২ লাখ ৭২ হাজার ৪ শ’ ৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩ শ’ ৮০ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৯২ জন। ভোট কেন্দ্র ৯৮টি এবং ভোট কক্ষ ৫শ’ ৫৫টি।কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাক্ষণপাড়া) আসনে ৩ লাখ ২০ হাজার ৮শ’ ৮৮ জন ভোটার। এর মধ্যে পরুষ ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৬১ হাজার ১শ’ ২০ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭শ’ ৮৬ জন। মোট ভোট কেন্দ্র ১শ’ ২১টি এবং ভোট কক্ষ ৬শ’ ৪৪টি। নতুন ভোট কেন্দ্র ১৭টি।
কুমিল্লা-৬ (আর্দশ সদর) আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩শ’ ৭৯ জন। ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫শ’ ৯০ জন পুরুষ এবং ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭শ’ ৮৯ জন নারী ভোটার। ভোট কেন্দ্র ১০১টি এবং ভোট কক্ষ ৬শ’ ২১টি। নতুন ভোট কেন্দ্র ২২টি।কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসনে নতুন করে সীমানা বিন্যাস করে এলাকার আয়তন কমে যাওয়ায় ভোটার সংখ্যা, ভোট কেন্দ্র এবং ভোট কক্ষের সংখ্যাও কমেছে। এ আসনে বর্তমান ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫২ হাজার ৮শ’ ৯৭ জন এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২২ হাজার ৫শ’ ৭৩ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩০ হাজার ৩ শ’ ২৪ জন।
এ আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কালীন মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৭ হাজার ২ শ’ ১১ জন। বর্তমানে ভোটার সংখ্যা কমেছে ৬৪ হাজার ৩ শ’ ১৪ জন। বর্তমানে এ আসনে ভোট কেন্দ্র ৮৬টি এবং ভোট কক্ষ ৪ শ’ ৮৯টি। নতুন ভোট কেন্দ্র ২০টি।নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র ছিল ৯৯টি এবং ভোট কক্ষ  ছিল ৬শ’ ১৭টি। ভোট কেন্দ্র কমেছে ১৩টি এবং ভোট কক্ষ কমেছে ১শ’ ২৮টি।কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনে এবার মোট ভোটার ৩ লাখ ২২ হাজার ৩ শ’ ১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪ শ’ ৭৭জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮ শ’ ৩৮ জন। ভোট কেন্দ্রে ১ শ’ ১৭টি এবং ভোট কক্ষ ৬ শ’ ৬৯ টি। নতুন ভোট কেন্দ্র ১৪ টি।
এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশের জন্য সবরকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসন। এজন্য জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং অফিসে স্থাপন করা হয়েছে নির্বাচন ফলাফল ঘোষণার কন্ট্রোল রুম। রিটানিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মো: তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার জন্য উন্নত তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। সর্বোচ্চ সর্তকতার মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করা হবে। এজন্য প্রশাসন থেকে সবরকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।