electiol_05.01স্টাফর করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা: নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যদিয়ে ইতিমধ্যে ক্ষমতাশীন আ’লীগের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের হরতাল, অবরোধ, বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে নাশকতা ও হামলার মধ্য দিয়ে রবিবার বিকাল ৪টায় ১৪৭ আসনে দশম সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে।

এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, প্রধান বিরোধী দলসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়ায় ভোটার উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। নবম সংসদে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়লেও বহুল আলোচিত বিএনপির একতরফা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সর্বনিম্ন ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের হার জানাতে পারেনি ইসি।

মোট ১৪৭ আসনের ১৮ হাজার ২১৩ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫৪৬ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও পোলিং এজেন্টদের মারধর করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে ১০ স্বতন্ত্রসহ ১৩ প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরে এ ধরনের ঘোষণার আইনি সুযোগ না থাকায় তারা যে ভোট পেয়েছেন তা গণনা করবে ইসি।

বিরোধী দল ছাড়া এবারের নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৪০ শতাংশ হলেই খুশি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বললেন, ৪০ শতাংশ ভোট পড়লেই আমরা খুশি। যুক্তরাজ্যেও এমন ভোটের হার রয়েছে। ভোটের পরে রাত ৯টার দিকে সিইসির কক্ষ থেকে বেরিয়ে তিনি এ প্রতিক্রিয়া জানান। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ ও বিভিন্ন কেন্দ্রে নাশকতা-হামলার মধ্য দিয়ে গতকাল ভোট হয়। কেমন ভোট পড়তে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৪০ শতাংশ ভোট পড়লেই আমরা খুশি। গ্রেট ব্রিটেনেও এমন ভোট পড়ে। এটাকে সেখানে স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। তবে ৫০ শতাংশ ভোট আশা করেন কি-না জানতে চাইলে নিজের সন্তুষ্টির কথা তুলে ধরেন এভাবেই।

নাশকতা-হামলায় গতকাল ১৮ হাজার ২১৩ ভোটকেন্দ্রের অন্তত ৫৪৬টি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করতে হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনে এ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। তবে সারাদিন এ নিয়ে ইসি লুকোচুরি করেছে। ৩৬টি আসনে ব্যালট পেপার ছিনতাই, ব্যালট পোড়ানো ও কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়ায় ৫৪৬ কেন্দ্র স্থগিত করা হয়। নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক গত রাত সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সর্বোচ্চ ৬০টি কেন্দ্র স্থগিত হওয়ায় এবার যশোর-৫ আসনে পুনঃভোট হতে পারে। এ বিষয়ে ইসি পরে সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে মহাজোট নেতাদের সঙ্গে সিইসির বৈঠকের পরে বন্ধ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা প্রকাশ বন্ধ করে দেয় ইসি।

ইসির সূত্রে জানা যায়, সহিংসতায় বন্ধ ভোটকেন্দ্র বিষয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত ইসি সচিবালয়ের তৈরি করা তালিকায় দেখা যায় ঠাকুরগাঁও-১ আসনে ১৯টি, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ১টি, দিনাজপুর-১ আসনে ২টি, দিনাজপুর-৩ আসনে ২টি, দিনাজপুর-৪ আসনে ৩৫টি, দিনাজপুর-৫ আসনে ১টি, দিনাজপুর-৬ আসনে ৭টি, নীলফামারী-১ আসনে ১১টি, নীলফামারী-৩ আসনে ৪টি, রংপুর-৩ আসনে ৭টি, রংপুর-৪ আসনে ৪৫টি, রংপুর-৬ আসনে ২টি, কুড়িগ্রাম-১ আসনে ১টি, কুড়িগ্রাম-৪ আসনে ১টি, গাইবান্ধা-১ আসনে ৩৪টি, গাইবান্ধা-২ আসনে ৬টি, গাইবান্ধা-৩ আসনে ২৫টি, গাইবান্ধা-৪ আসনে ৪৯টি, বগুড়া-৭ আসনে ৪৬টি, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে ১টি, ঝিনাইদহ-৩ আসনে ১৫টি, যশোর-৫ আসনে ৬০টি, মাগুরা-২ আসনে ২টি, জামালপুর-৪ আসনে ২টি, শেরপুর-১ আসনে ১টি, শেরপুর-৩ আসনে ১টি, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে ১টি, মৌলভীবাজার-১ আসনে ১টি, হবিগঞ্জ-২ আসনে ২টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে ২টি, কুমিল্লা-৩ আসনে ১টি, কুমিল্লা-৯ আসনে ১৫টি, ফেনী-৩ আসনে ১টি, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে ২১টি, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে ১০টি, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে ২টি। ইসি সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক জানান, শেষ পর্যন্ত স্থগিত কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩৬টি। দেশের ১৪৭ আসনের ১৮ হাজারের বেশি কেন্দ্রের মধ্যে এ স্থগিত হওয়াটা ‘প্রত্যাশার’ বাইরে।

এদিকে বিকাল সাড়ে ৩টায় নির্বাচন কমিশনে আসেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রচারণা আহ্বায়ক ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এ সময় তিনি বলেন, বিরোধী দল নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। সারা দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচন অনেক উন্নত দেশের তুলনায় গ্রহণযোগ্য ও সন্তোষজনক হয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানো, ভোট দিতে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে জাতীয় পার্টি। গতকাল নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজের সঙ্গে জাতীয় পার্টির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল দেখা করে এ অভিযোগ করে। জাতীয় পার্টির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

বেলা ১১টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ রাজধানীর বকশি রাজার বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী রাজধানীর মুসলিম মডার্ন একাডেমিতে ভোট দেন। এ ছাড়া শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও বিএএফ শাহীন কলেজের ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন।

ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও পোলিং এজেন্টদের মারধর করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে ১০ স্বতন্ত্রসহ ১৩ প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এরা হলেন- ঢাকা-১৫ আসনের মোহাম্মদ এখলাস উদ্দিন মোল্লা, শেরপুর-২ আসনের বদিউজ্জামান বাদশা, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের শওকত আলী, বরগুনা-২ আসনের আবুল হোসেন শিকদার, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের আতাউর রহমান রতন, লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের এ কে এম শরিফ উদ্দিন ও আজাদ উদ্দিন চৌধুরী, বরিশাল-২ আসনের সাবিনা আখতার, জামালপুর-১ আসনের আজিজ আহমেদ হাসান ও জামালপুর-২ আসনের আতিকুর রহমান। এ ছাড়াও রয়েছেন চট্টগ্রাম-১২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জামালপুর-৫ আসনের জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রার্থী বাবর আলী খান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের ফরিদ আহমেদ।

এ বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের উপসচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমার পর ভোটে না থাকার কোনো সুযোগ নেই। আইনগতভাবে তারা প্রার্থী। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি। ঢাকায় দুপুরে নির্বাচন কমিশনে হাজির হয়ে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন কাজীপাড়া, সেনপাড়া, শেওড়াপাড়া, তালতলা (একটি অংশ) ও ইব্রাহীমপুরসহ কাফরুল থানা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এখলাস উদ্দিন মোল্লা। তিনি বলেন, সরকার ঘোষণা দিয়েছিল সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হবে। আমরাও তা বিশ্বাস করেছিলাম। জনগণও বিশ্বাস করেছিল।

সর্বশেষ রাত ২টার দিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সিইসি। তিনি জানান, ৯৭ শতাংশ কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। তবে সব দল অংশ নিলে নির্বাচন আরও ভালো হতো। তিনি জানান, স্থগিত কেন্দ্রগুলোতে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে আবার ভোট হবে। এ সংসদের মেয়াদ ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত থাকায় এর মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, জয়-পরাজয়ের ব্যবধানের চেয়ে স্থগিত কেন্দ্রে ভোটার বেশি হলেই পুনঃভোট হবে, স্থগিত কেন্দ্রে কম ভোট থাকলে পুনঃভোটের প্রয়োজন পড়বে না