জাপাবিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা: আওয়ামী লীগ এরশাদকে পাশে রাখতে যে কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত। তেমনি জাপার নেতারা আ’লীগে থাকতে ইচ্ছুক। তাই দলটির পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে সমঝোতার শেষ পর্ব। এরশাদের মান ভাঙ্গানোর মিশনে নেমেছেন আ’লীগের শীর্ষ নেতারা।

এছাড়া আ’লীগের এক শীর্ষ নেতাকে এরশাদের মান ভাঙ্গানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরশাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূতিয়ালি করছেন তাঁর স্ত্রী রওশন।

বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকও করেছেন তিনি। আজ শপথ নিতে পারেন সাবেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যে কোন সময় হাসপাতালের অন্তরীণ অবস্থা কাটবে তাঁর।

সরকারের মন্ত্রী পরিষদ ও বিরোধী দল উভয় দিকেই থাকার ব্যাপারে একমত দলটির বেশিরভাগ নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তবে এরশাদের মত বিরোধী দলে থাকার। সবকিছুই নির্ভর করছে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতার ওপর।

প্রশ্ন জাগতেই পারে কেমনে মান ভাঙ্গবে এরশাদের? কিংবা রাজনৈতিক সমঝোতাই বা কি অপেক্ষা করছে আওয়ামী লীগ ও জাপার মধ্যে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের যাত্রা শুরুর পর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এরপর থেকেই এরশাদের মুখ থেকে বার বার উচ্চারিত হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা।

এ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। ঘোষণা দিয়েছিলেন এককভাবে অংশ নেবেন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এরপরও সর্বশেষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ৩ ডিসেম্বর নাটকীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন এরশাদ। এরপর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আত্মগোপনে থাকার পর প্রকাশ্য হন তিনি।

জাপা নেতাদের ভাষ্য, নির্বাচনের আগেই এরশাদ পল্টি দিতে পারেন তা টের পেয়েই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে মঞ্জুর হত্যা মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। অর্থাৎ নির্বাচনের আগে মামলাটির চূড়ান্ত রায়ের তারিখ ঠিক ছিল। পাশাপাশি আসন বণ্টন নিয়ে দু’দলের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগের কাছে ৮০টি আসন চেয়েছিলেন এরশাদ। ক্ষমতাসীন দল এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রচ- ক্ষুব্ধ হন জাপা চেয়ারম্যান। মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকার থেকে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন সংসদ সদস্য প্রার্থীদের।

এরপর এরশাদের মান ভাঙ্গাতে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। লাভ হয়নি। তেমনি জাপার মন্ত্রীরাও ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ ছিলেন। এরপর গত ১২ ডিসেম্বর রাতে র্যাবের পাহারায় তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

দলের হাল ধরেন রওশন। তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচন করে জাপা। দলের মধ্যে দেখা দেয় সাময়িক বিভক্তি। ইতোমধ্যে এরশাদের নির্দেশে ১২০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এরশাদসহ জাপার হেভিওয়েট অনেক নেতাই মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন জানালে তা গৃহীত হয়নি।

শেষ পর্যন্ত তিনটি আসনের মধ্যে একটিতে পাস করেন এরশাদ। নির্বাচনে পরাজিত হন এরশাদের ভাই জি এম কাদের। ৩৩টি আসনে জয়লাভ করেন জাপার প্রার্থীরা। এর মধ্যে ২০ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তারা। এমন অবস্থায় রওশনকে বিরোধী দলের নেতা মেনে নিয়ে শপথ নিয়েছেন জাপার সংসদ সদস্যরা।

জাপা সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন এরশাদ। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার, মঞ্জুর হত্যামামলা খারিজ করা, তাঁর নির্দেশ মেনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে যাঁরা সাংসদ হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন, তাঁদের ব্যাংক-বীমা-কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া,
জি এম কাদেরকে উপনির্বাচনে জয়ী করে সংসদে আনা ও জাতীয় পার্টি থেকে কাউকে মন্ত্রী না করা। তবে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের একটি আসন ছেড়ে দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে এই আসনটি জি এম কাদেরকে দেয়া হবে।

জাপার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, টানা ২৮ দিন ধরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) থাকা এরশাদ নির্বাচনের পর সরকারকে এসব শর্ত দিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, তাঁর এ শর্তগুলো মানলে দশম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হতে তাঁর আপত্তি নেই। শপথও নেবেন তিনি।

অন্যথায় তিনি যেভাবে আছেন, প্রয়োজনে সেভাবেই থাকবেন। মন্ত্রী পরিষদে জাপার অংশগ্রহণে রাজি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার শপথ নেননি এরশাদ। তাই বৃহস্পতিবার থেকে আবারও তার মান ভাঙ্গানোর মিশনে নেমেছে আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা। রাতের মধ্যে সমঝোতা হলে আজ শপথ নিতে পারেন এরশাদ। অন্যথায় একদিন পরে অর্থাৎ শনিবার শপথ নেবেন তিনি।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শুক্রবার অথবা শনিবার শপথ গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, আমরা এরশাদের নির্দেশেই নির্বাচনে গিয়েছি এবং জাতীয় সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দল হব। মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

দলটির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকার পাশাপাশি দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায়ও থাকতে চায় জাতীয় পার্টি। তিনি বলেন, আমরা সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকছি আবার বিরোধী দলেও থাকছি। এটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার হবে।

দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকে রওশন এরশাদকে নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। অন্য কেউ কিছু বললে তা আর কার্যকর হবে না। তাই দশম সংসদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতা রওশনই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হতে চলেছেন। সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকার বিষয়ে চুন্নু বলেন, এ বিষয়ে কোন লিখিত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে একই সঙ্গে মন্ত্রিসভায় ও বিরোধী দলে থাকার পক্ষে আমাদের বেশিরভাগ সাংসদ মত দিয়েছেন।

রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয় এরশাদ তাঁকে বিরোধী দলের নেতা হতে বলেছেন। এরশাদের বক্তব্য সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি। তাই বিরোধী দলের নেতা হতে রাজি নন। তবে রওশনের এমন বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্ন মত রয়েছে এরশাদপন্থী দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেছেন, বিরোধী দলে যাওয়া, এরশাদের মুক্তি ও শপথ নেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্পষ্ট।

তারা বলছেন, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করা হলেও পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি। এ ছাড়া এরশাদের পক্ষ থেকে রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার সম্মতি দেয়া হয়নি। কেউ কেউ জানিয়েছেন, সরকারের অব্যাহত চাপের মুখে শপথ নিতে সম্মত এরশাদ। অন্যথায় তাকে মুক্তি দেয়া নাও হতে পারে। তবে এরশাদ প্রকাশ্যে এলে বিরোধী দলের নেতা কিংবা নীতিনির্ধারণী অনেক ক্ষেত্রেই নাটকীয় পরিবর্তন আসতে পারে।