উপজেলা নির্বাচনবিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা: নানা আলোচনা-সমালোচনা, আন্দোলন-সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রাতারাতি শেষ হলো সরকার গঠনের কাজও। নির্বাচনে অংশ না নেয়া বিএনপি নতুন সরকারের পতনে রাজপথে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ অবস্থায় আন্দোলন ঠেকাতে স্থানীয় নির্বাচনের ওপর ভর করতে যাচ্ছে সরকার। সরকার গঠন শেষ হতে না হতে শুরু হয়েছে দেশব্যাপী উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর প্রস্তুতি।

এপ্রিলেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ৪৮৯ কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে। শিগগির উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কমিশনে চিঠি পাঠানো হবে।

পর্যায়ক্রমে নির্বাচন উপযুক্ত পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন করারও প্রস্তুতি রয়েছে ইসির। বিএনপি দশম নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের ঠেকাতে পারবে না বলে মনে করছে সরকার।

তা ছাড়া তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে ব্যস্ত থাকলে আন্দোলনের গতিপথও ভিন্ন খাতে চলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আন্দোলন শক্তিশালী করার পথে নির্বাচনকে দাঁড় করানো হচ্ছে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে। ৪৮৭টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। মার্চের শুরুতেই তফসিল ঘোষণা করে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট গ্রহণের টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই এ নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে।

পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনে হালনাগাদকৃত ভোটার তালিকা দিয়েই এ নির্বাচন সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি মাসেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করা হবে বলেও ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। এ নির্বাচনে সম্ভাব্য বাজেট ধরা হয়েছে     ৪৮৯ কোটি টাকা।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, নতুন সরকার গঠনের পরপরই উপজেলা নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করা হয়েছে। ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহকে মাথায় রেখে সব কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, রোববার নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহ নেওয়াজ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের কাজ শেষে উপজেলা নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব করে ফেলা হবে। আইন অনুযায়ী মের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই উপজেলা নির্বাচন করতে হবে। তবে কখন এ নির্বাচন করা হবে সে বিষয়ে কমিশন বৈঠকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোঃ শহীদ খান বলেন, স্থানীয় সরকারের উপজেলা নির্বাচন করার বিষয়ে শিগগিরই নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়া হবে। কারণ আইন অনুযায়ী এ নির্বাচন করতে হবে। তবে নতুন মন্ত্রী শপথ নেয়ার কারণে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে বলেও জানান তিনি।

ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সংসদ নির্বাচনের জন্য যে ভোটার তালিকা করা হয়েছে তা দিয়েই উপজেলা নির্বাচন করা হবে। তবে নতুন ভোটার আলাদা কাগজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাশাপাশি এ নির্বাচনের জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই শুরু করবে ইসি। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সারা দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। বর্তমানে ৪৮৭টি উপজেলা রয়েছে।

এসব উপজেলার শপথ একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হলেও প্রথম বৈঠক হয় ২০০৯ সালের এপ্রিল-মে’র ভিন্ন ভিন্ন তারিখে। আইন অনুসারে উপজেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের মেয়াদ হবে প্রথম বৈঠক থেকে পাঁচ বছর। সে মোতাবেক ২০১৪ সালের মের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এসব উপজেলা নির্বাচন করতে হবে।

আইনানুযায়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা (পুরুষ-মহিলা) সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলেও ২০০৯ সালে সংরক্ষিত মহিলা সদস্যদের নির্বাচন আইনি জটিলতায় আটকে যায়। এখন পর্যন্ত সে পদে নির্বাচন হয়নি। সম্প্রতি কমিশন এসব পদে নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন করেছে।

ভোট কেন্দ্র ও মালামাল প্রস্তুতি : উপজেলা নির্বাচনের জন্য সারা দেশে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছে ইসি। সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রের হিসাবে নেয়া হচ্ছে সব প্রস্তুতি। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৮২৪টি অমোচনীয় কালির কলম, সমপরিমাণ অফিসিয়াল সিল, ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৪২৮টি মার্কিং সিল,

প্রতি ভোট কেন্দ্রে একটি করে ৪০ হাজার ৬০০টি ব্রাস সিল, ৫ লাখ ২৭ হাজার ৮২৬টি স্ট্যাম্প প্যাড, ৪৪ হাজার ৬৭২টি গানিব্যাগ, সমপরিমাণ হেসিয়ান ব্যাগ, ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৮০টি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের সিল ক্রয় করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ নির্বাচনের জন্য অতিরিক্ত ২০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ক্রয় করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফরম মুদ্রণ করা হয়েছে।

ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮৯ কোটি টাকা : চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮৯ কোটি টাকা। খাতওয়ারি অর্থ বরাদ্দের হার বিগত নির্বাচনের চেয়ে দ্বিগুণ বা অনেক ক্ষেত্রে তিনগুণ ও চারগুণ করা হয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসারের সম্মানী ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ৭০০ থেকে ২ হাজার এবং পোলিং অফিসারদের ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকা করা হয়েছে।

এবার প্রতি কেন্দ্রে গড়ে নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের পেছনে ব্যয় হবে ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি অস্থায়ী কেন্দ্রের ৩ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার ও প্রতি কক্ষের জন্য ১ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। প্রতি কেন্দ্রের মনিহারি দ্রব্যের জন্য ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০, ঢাকা থেকে মালামাল পরিবহনে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার,

জেলা সদর থেকে মালামাল পরিবহনে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার, ভোটকন্দ্রে মালামাল প্রেরণ ও ফেরত আনয়ন বাবদ সাধারণ এলাকার ৮০০ থেকে ৩ হাজার, দুর্গম এলাকার ১ হাজার ২০০ থেকে ৫ হাজার, রিটার্নিং অফিসারের ডাক, ফ্যাক্স ও আপ্যায়ন খরচ ৩৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

এছাড়া সহকারী রিটার্নিং অফিসারের ডাক, ফ্যাক্স ও আপ্যায়ন খরচ ৩৫ হাজার, রিটার্নিং অফিসারের যাতায়াত বাবদ সর্বোচ্চ ৩ লাখ, সহকারী রিটার্নিং অফিসারের যাতায়াত বাবদ সর্বোচ্চ ১ লাখ, জেলা নির্বাচন অফিসারের ডাক, ফ্যাক্স ও আপ্যায়ন বাবদ ৩০ হাজার, জেলা নির্বাচন অফিসারের যাতায়াত বাবদ ৪০ হাজার, থানা বা উপজেলা নির্বাচন অফিসারের যাতায়াত বাবদ ২০ হাজার, ফল সংগ্রহের কন্ট্রোল রুম স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় ৬০ হাজার,

রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের খ-কালীন করণিক ও পিয়ন বাবদ ১১ হাজার, বিভাগীয় কমিশনার ডাক, ফ্যাক্স, আপ্যায়ন ও অনুষঙ্গিক ব্যয় ৫০ হাজার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার ডাক, ফ্যাক্স, আপ্যায়ন ও অনুষঙ্গিক ব্যয় ৬০ হাজার, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওভারটাইম বাবদ প্রতিদিনের জন্য ৪০০,

৩৯৫, ৩৯০ ও ৩৮৫ হারে বরাদ্দ, নির্বাচনী তদন্ত কমিটির ব্যয় গড়ে ৬০ হাজার, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত মোবাইল স্ট্রাইকিং ফোর্সের ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রত্যেকের প্রতিদিন ৫ হাজার, আপিল কর্তৃপক্ষ ডাক, তার, কন্ট্রোল রুম পরিচালনা ও আপ্যায়ন খরচ বাবদ ৩ লাখ,

জেলা প্রশাসক/আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা/জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা/প্রধান সমন্বয়কারী পর্যবেক্ষক, ভিজিলেন্স টিম, অবজারভেশন টিম মনিটরিং টিম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেলের মনিহারি দব্য ক্রয়, ডাক, যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক ব্যয় ৫০ হাজার, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ও আপ্যায়ন খরচ প্রতি নির্বাচনী এলাকায় ৫০ হাজার,

রিটার্নিং অফিসারের সহায়তা ও পর্যবেক্ষক টিমের পর্যবেক্ষকদের ডাক, ফ্যাক্স, আপ্যায়ন ও অনুষঙ্গিক খরচ প্রতি নির্বাচনী এলাকার জন্য ২০ হাজার, নিজস্ব পর্যবেক্ষক প্রতিদিনের জন্য ৫ হাজার ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স পরিষ্কারকরণ, কুলি খরচ ও পরিবহন খরচ বাবদ প্রতি ব্যালট বাক্সের জন্য ১০ টাকা হারে বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া বাকি অর্থ পুরোটাই যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে।

আটকে আছে ৩৩ উপজেলা নির্বাচন : জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঢামাঢোলের কারণে নির্দিষ্ট সময় পরও নির্বাচন করেনি ইসি। সময় পার হওয়া ২৯ উপজেলার উপনির্বাচন ও নবগঠিত চার উপজেলা নির্বাচন করেনি কমিশন।

স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচন না করতে গত বছর সেপ্টেম্বরে ইসিকে অনুরোধ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। আইনে নবগঠিত উপজেলা পরিষদ গঠনের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়। উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে তা করার বিধান রয়েছে। ২৯ উপজেলায় মৃত্যু ও পদত্যাগজনিত কারণে চেয়ারম্যান পদ শুন্য হয়। সুত্র: আ. বাংলাদেশ