সংখ্যালঘুদের-উপর-হামলাস্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা: আ’লীগ বলুন আর বিএনপিই বলুন যে সরকারই বিগত দিনে ক্ষমতায় এসেছিল সেই সরকারের আমলেই সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিকারে নির্যাতন চালানো হয়েছে। যতই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চমৎকার নজীর উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাক না কেন তাতে ব্যর্থতার প্রমান দিয়েছে।

অনেক বাড়ি-ঘর ও দোকান-পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে ঘরছাড়া হয়েছেন আবার অনেক গৃহবধূ তার পরিবারের লোকজনের সামনে নির্বিকারে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এমনকি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাও সবারই জানা। তাই সংখ্যালঘুদের উপর হামলা মানেই যদি বিএনপি-জামায়াত হয় তাহলে আ’লীগ কি ধোয়া তুলশী পাতা।

এসব হামলার ঘটনা ফলাও করে প্রচার করছে মিডিয়াগুলো। আর টেলিভিশনের টকশোতেও জায়গা করে নিয়েছে এই হামলার ঘটনা। প্রায় সব মিডিয়াই সম্ভবত নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বলছে, জামায়াত শিবির ও বিএনপি এই হামলা করছে। আর টকশোগুলোতেও দেশের বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবীরা ঝড় তুলছেন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে। তারাও এসব হামলার জন্য জামায়াত শিবির ও বিএনপিকেই দায়ী করছেন। কেউ কেউ এজন্য সরাসরি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে কাঠগড়ায় দাড় করানোর কথাও বলছেন।

তবে এসব হামলার একটিও কোন ধর্মীয় ইস্যুকে ঘিরে হয়নি। ধর্মীয় উৎসব কিংবা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন কোন সংখ্যালঘু এমন নজীর বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর যত আক্রমণ হয়েছে তার সবই রাজনৈতিক। বিশেষ করে নির্বাচনকে ঘিরে এই হামলার ঘটনা ঘটেছে বেশী। এবারও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। নির্বাচনের আগে থেকেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।

হামলার দায় বিএনপি জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলেও বেশ কিছু জায়গায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছেন। তাদের অনেককে আবার পুলিশের হাতে সোপর্দও করা হয়েছে। পুলিশ অবশ্য পরে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে ওপরের নির্দেশে।

তবে সংখ্যালঘুদের ওপর ছাত্রলীগ বা যুবলীগের হামলার খবরগুলো কৌশলে চেপে যাচ্ছে মিডিয়াগুলো। কিছু কিছু মিডিয়া অবশ্য ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নাম মুখে না এনে ‘দুর্বৃত্তরা’ এ হামলা করেছে বলে চালিয়ে দিচ্ছে। আর বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবীরা শুধু চেপেই যাচ্ছেন না, যেসব এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে সেসব এলাকার নামই মুখে আনছেন না।

শুধু এবারই নয় এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সবচেয়ে বড় ও আলোচিত ঘটনা রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা। ওই ঘটনার পর দেশের মিডিয়াগুলো সরব ছিল। সরব ছিলেন দেশের বুদ্ধিজীবীরাও। সবারই এক কথা, জামায়াত শিবিরই এ হামলা চালিয়েছে। আর সহযোগিতা করেছে বিএনপি।

কিছু বুদ্ধিজীবী তো জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করেই বলে দিলেন তারা ঘটনাস্থলে থেকে এই হামলা চালিয়েছেন। সরকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিল দোষীদের খুঁজে বের করতে। শুরু হয়েছিল তদন্ত। তদন্তকারীরাও বীরদর্পে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু মাঝ পথে থেমে গেলেন। তদন্ত করতে গিয়ে যুবলীগ কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়ে অসম্পুর্ণ তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। অধিকাংশ মিডিয়াই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার খবরটি প্রকাশ করলেও রিপোর্টের ভেতরের কথা চেপে যায়।

এ নিয়ে কোন ফলোআপ প্রতিবেদনও হয়নি মিডিয়াগুলোতে। আর বুদ্ধিজীবীরা? তারা তো এ প্রসঙ্গ টকশো-তে আনতেই নারাজ। কারণ এ নিয়ে সরব আলোচনার উপাদান তাদের পক্ষে নেই। তবে তদন্তের আগে রামুর ঘটনা নিয়ে এত বেশী আলোচনা হয়েছিল যে, ঘটনাটি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করা হলেও এখনও মানুষ ওই ঘটনার কথা ভুলতে পারেননি। এদেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ এখনও ওই ঘটনার বিচার চান।

অবশ্য কেউ কেউ যে ছাত্রলীগ বা যুবলীগের জড়িত থাকার কথা বলছেন না তা নয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির কয়েকটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসে বিবিসিকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ কিছু এলাকায় জামায়াত শিবিরের সাথে হাত মিলিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করেছে। তিনি একথাও বলেছেন, জামায়াতের টাকার কাছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বশীভূত হয়েছেন।

হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের নেতা এডভোকেট সুব্রত বড়ুয়া বিবিসিকে বলেছেন, জামায়াত শিবির হামলা করছে এটা এখন একটা শ্লোগান হয়ে গেছে। বাস্তবে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজন রয়েছেন। অবশ্য সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বিবিসিকে বলেছেন, এসব হামলার সাথে আওয়ামী লীগ জড়িত নয়। সুব্রত চৌধুরীর বক্তব্যকে তিনি মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন।

সরকারের পক্ষ থেকে এসব অস্বীকার করা হলেও কিছু মিডিয়ার কল্যানেই মানুষ অনেক তথ্য জেনে গেছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীরা তাদের শান্তনা দিতে এলাকায় গেলে প্রতিমন্ত্রীর সাথে হামলাকারীর ছবি দেখা গেছে মিডিয়ায়।

শুরুতেই বলা হয়েছে এদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ধর্মীয় ইস্যুকে ঘিরে নয়, হামলা হচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যুকে ঘিরে। রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে কিছু সুযোগ সন্ধানী এই হামলা চালিয়ে বাহবা নিচ্ছেন। আর দোষ চাপানো হচ্ছে জামায়াত শিবিরের ওপর। আর জামায়াত যে ১৮ দলীয় জোটের শরীক সেই জোটের নেত্রী খালেদা জিয়া হওয়ায় তিনিও দায়মুক্ত হতে পারছেন না।

জামায়াত শিবির সারাদেশে হরতাল অবরোধের নামে সহিংসতা চালাচ্ছে একথা যেমন সত্যি তেমনই একথাও সত্যি যে, তারা গ্রেফতার আতংকে অনেকেই ঘরছাড়া। নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যই অনেকে ব্যর্থ। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো তাদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক কঠিন। তাছাড়া সব দিক থেকে প্রতিকূল অবস্থায় থাকা জামায়াত শিবির এই সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মত বদনাম কাঁধে নিতে চাইবে না।

তবে ঘটনা যাই হোক, সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস কিংবা মিডিয়ার কল্যানে যেভাবেই হোক না কেন- এসব হামলার জন্য জামায়াত শিবির আর বিএনপি দায়ী এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানীরা। সে কারণেই ১৮ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার ওপরও দায় পড়ছে অনেকটা।

শুধু যে সুযোগ সন্ধানীদের চাপিয়ে দেয়া কিংবা মিডিয়ার প্রচারের কারণেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার দায় চাপছে বিএনপি’র ওপর তাই নয়। এর পেছনে বিএনপি ভূমিকাও কম নয়। বিএনপি তার জন্মলগ্ন থেকেই এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে তার রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে গেছে। কখনও প্রতিকূল অবস্থায় পড়লেও ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে।

শুরুর দিকে বিষয়টি অনেকটা নীরবতার মধ্য দিয়েই মানুষের মনে লেগে গেলেও নব্বই দশক থেকে তা অনেকটা স্পষ্ট। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ভোটযুদ্ধে জয়ী হলে দেশ ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে-এমন বক্তব্য ছিল বিএনপি নেতাদের মুখে মুখে। শুধু তাই নয়, এখন থেকে আর মসজিদে আজান শোনা যাবে না, মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি, ঢাক, ঘন্টা আর সঙ্খের শব্দ শোনা যাবে- এমন বক্তব্যেও সরব ছিলেন বিএনপি’র নেতারা।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পরও এমন বক্তব্য ছিল বিএনপি নেতাদের মুখে মুখে। এ ধরণের বক্তব্যে অনেক মানুষই বিভ্রান্ত হয়েছেন। এই বিভ্রান্তিই যেন আজ বিএনপি’র কাঁধে চেপেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর কারা হামলা করছে তা তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতই যে এ হামলা করছে এটা কিন্তু সফলভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বিএনপি বিরোধীরা।