alig-bnpআলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক, প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিকে সেই নির্বাচনে ফেরাতে কোনও উদ্যোগ নেবে না শাসক দল। আওয়ামী লীগ মনে করে, সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংলাপের আশায় গোঁ ধরে বসে থাকলে একাদশ সংসদ নির্বাচনও হতে পারে বিএনপিকে বাইরে রেখেই।

সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে এক চুলও ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীনরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা এই মনোভাবের কথা জানান।

তবে ডিসেম্বর ধরলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আট মাসের মতো বাকি। তফসিল ঘোষণার বাকি মাত্র পাঁচ মাসের মতো। যদিও নির্বাচনকালীন সহায়ক বা তত্ত¡াবধায়ক সরকার ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয় মুখে এমনটা বলছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা; কিন্তু সাংবিধানিক ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বাধ্যবাধকতা থাকায় এসব দাবি পূরণ ব্যতিরেকেই শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এমন ভাবনাও রয়েছে দলের মধ্যে।

দল যে এবার নির্বাচনে অংশ নেবে, তা হরহামেশায় বলছেনও শীর্ষনেতারা। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের হিসেবেও এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। গতকালও আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদ বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলেও ধরে রেখেছেন তারা। এমনকি এবার নির্বাচন যেসব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হবে, সরকারের এমন সদিচ্ছাও প্রকাশ পেয়েছে।

ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য এখন নির্বাচনী প্রচারণা ও নির্বাচনী মাঠের রাজনীতির দিকে। বিশেষ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে দুই চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কী করছে; তা জানতে উদগ্রীব সাধারণ মানুষও। পরস্পরের নির্বাচনী কৌশল বুঝে পাল্টা কৌশল প্রণয়নে সেদিকে তীক্ষè নজর দুই দলেরই। নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে এসে প্রচারণায় ও মাঠের নির্বাচনী রাজনীতিতে কে এগিয়ে, সে নিয়ে নানা বিচার-বিশ্লেষণ চলছে রাজনৈতিক মহল ও বিশ্লেষকদের মধ্যেও।

দলীয় সূত্রমতে, নির্বাচনের আট মাসের মতো বাকি। কিন্তু বিএনপিকে এখনো নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এখনো দলটি বন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ঘিরে। আবার সে আন্দোলনেও গতি নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান তো বটেই; এবার নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণও অনিশ্চিত বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। যদি তাই হয়, তা হলে ঠিক কোন ভিত্তিতে এবং সাংগঠনিক কাঠামোয় দলটি নির্বাচন করবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয় দলেই।

সূত্রগুলো আরো বলছে, দল অপেক্ষা করছে আওয়ামী লীগের চ‚ড়ান্ত নির্বাচনী মেরুকরণের ওপর। সেটা দেখেই প্রচারণা কৌশল নেবে দলটি। সে হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণায় দলের হাতে সময় থাকে মাত্র তিন মাসের মতো। কিন্তু এত অল্প সময়ে নির্বাচনের জন্য নিজেদের গুছিয়ে তোলার যোগ্যতা দলের ঠিক কতটা রয়েছে, সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, বিএনপির যে অবস্থা, তাতে কি দলটি পারবে সরকার বা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী রাজনীতির কৌশলে টেক্কা দিতে? সে সামর্থ্য কি দলের রয়েছে?

একইভাবে বেশ কিছু ইস্যুতে নির্বাচনী মাঠের রাজনীতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। যদিও দুই দলের নির্বাচনী প্রচারণা বা নির্বাচনী মাঠের রাজনীতির তুলনামূলক বিশ্লেষণে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক এগিয়ে; কিন্তু নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে দলের ভেতর ও বাইরে, বিশেষ করে জাতীয়ভাবে নানা সংকট দেখা দিচ্ছে। নানা ইস্যু তৈরি হচ্ছে।

সুযোগ পেয়ে সেসব ইস্যুতে সরকার বিরোধী রাজনীতির আভাসও মিলছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রায় দেড় বছর ধরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মাঠে। অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কাটিয়ে দলকে প্রায় গুছিয়ে এনেছে। চলছে মনোনয়ন বাছাই কাজ। সরকারও সতর্ক। নির্বাচনের প্রস্তুতিতে দলের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি আছে। প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী দল।

কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার বা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধ কাটেনি। শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। নির্বাচনের সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা মেরুকরণ দেখা দেবে রাজনীতিতে। সরকার বিরোধী নানা তৎপরতার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন প্রতিক‚ল পরিস্থিতি উতরাতে ঠিক কতটা প্রস্তুত বা সক্ষম সরকার অথবা আওয়ামী লীগ এমন প্রশ্নও উঠেছে নানা মহলে।

এ নিয়ে কী ভাবছেন দুই দলের নীতিনির্ধারকরা জানতে গতকাল কথা হয় দল দুটির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো ফর্মুলা দিয়ে বা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে লাভ নেই। নির্বাচন ঠেকানোর ক্ষমতাও কারো নেই।

নির্বাচন কেন্দ্র করে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। লক্ষ্য একটাই নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের জয়। দলের প্রতিটি সংসদীয় আসনে দলের নেতারা যাচ্ছেন, বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। স্থানীয় নেতাদের বলছেন, সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরতে। সাধারণ জনগণ যেন আবারও নৌকায় ভোট দেন, সে আহবান জানানো হচ্ছে।

অন্যদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি বর্তমানে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। সারা দেশে দলের নেতাকর্মীরা হত্যা, গুম ও মামলায় জর্জরিত। বেশ কয়েক বছর থেকে নেতারা এলাকায় যেতে পারেন না। তার পরও সাধ্যমতো সব কর্মসূচিতে যে পরিমাণ উপস্থিতি দেখা গেছে তা কোনো অংশে কম নয়।

বড় কথা হচ্ছে, বিএনপির নেতাকর্মীরা যে পরিমাণ দমন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ে থাকবে। তার পরও তাদের মনোবল কোনো অংশেই কমেনি। এটাই বিএনপির শক্তি। আগামী দিনের রাজপথ বিএনপিরই হবে।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রমতে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের আশা ও কৌশল নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সরকার ও দল। দলের তৃণমূলে কিছু অভ্যন্তরীণ বিরোধ থাকলেও রাজনীতির মাঠে এখন দলের অবস্থান ভালো। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিতরা যাতে সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়াতে না পারে; সেজন্য কঠোর নজরদারি করবে দলের হাইকমান্ড।

এলাকায় এলাকায় সাংগঠনিক কমিটি মনিটরিং করবে। কেন্দ্র থেকে গঠিত মনিটরিং কমিটি দলের যেসব নেতাকর্মী বিরোধিতা করবেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। তাদেরকে এলাকার শান্তিবিনষ্টকারী হিসেবে চিহ্নিত করে আইনি পদক্ষেপও নিতে পারে।

দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দুই ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দল। সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন দলের অর্ধশতাধিক নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীর রদবদল আসবে। নতুন মুখ দলীয় মনোনয়ন পাবেন। কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় নারীরাও মনোনয়ন পেতে পারেন। তবে জনপ্রিয়তা হারানো কিংবা জনবিচ্ছিন্ন কাউকে এবার কিছুতেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।

দল এমনও মনে করছে, দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ও তার ছেলে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া একরকম অনিশ্চিত বলেই নির্বাচন ভুন্ডুলের ষড়যন্ত্র করতে পারে বিএনপি। বিএনপি যাতে নির্বাচন ভুন্ডুল করতে না পারে, সেজন্য দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা সজাগ রয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকারের প্রশাসনও তার আইনি কাঠামোতে এগিয়ে যাবে।

অন্যদিকে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন দলের সিনিয়র নেতারা। সে ক্ষেত্রে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি ফয়সালা করে। তবে এ মুহূর্তে মাঠের রাজনীতিতে দলের জোরালো অবস্থান নেই বললেই চলে।

এ অবস্থায় নির্বাচনী মাঠের অবস্থান নিজেদের পক্ষে নিতে দলের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মাঠে সরকারি দলের শক্তিশালী অবস্থানের বিপরিতে বাকি অল্প সময়ে কতটা নিজেদের পক্ষে নিতে পারে; তা নিয়ে সন্দিহান দলের তৃর্ণমূল নেতাকর্মীরাও। যদিও দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ নামতে দিচ্ছে না। কিন্তু নির্বাচনী মাঠ দখলে রাখতে রাজনৈতিক শক্তির সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

দলীয় সূত্রমতে, এখন পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিতে পারেনি দল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না বললেও নির্বাচনকালীন সরকার গ্রহণযোগ্য করতে কোনো প্রস্তাবনাও দেয়নি। নির্বাচনী কৌশল নিয়ে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব দল।

খালেদা ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না দলের এমন ঘোষণায় দলীয় ভোটার ও সমর্থকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আবার খালেদার মুক্তির আন্দোলনে কঠোর অবস্থান না নেওয়াতে দলের মাঠের দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে।

দলের একাধিক সূত্র বলছে, মাঠপর্যায়ে দলের সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে নাজুক। ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ৩৮টি কমিটি দেওয়া হয়েছে। ঘোষিত জেলারগুলোর অধিকাংশ থানা ও পৌর কমিটিতে হাতই দেওয়া হয়নি। ২০-২৫ বছরের পুরনো কমিটিগুলো নিষ্ক্রিয়। চার বছর ধরে চলা কমিটির পুনর্গঠনের কাজ অর্ধেকও শেষ হয়নি। মূল দলের মতো অঙ্গসংগঠনগুলোর অবস্থাও একই। খালেদা জেলে যাওয়ায় বর্তমানে এসব কাজ বন্ধ হয়ে আছে।

দলের নেতাদের মতে, শক্তিশালী সংগঠন ছাড়া কোনোভাবেই মাঠে নিজেদের অবস্থান তৈরি করা যায় না। এ সত্য বিএনপি উপলব্ধি করতে না পারলে দলের পক্ষে মাঠ দখল অনেকটা সুদূর পরাহত। ফলে নির্বাচনের আগে রাজপথে বিএনপি কতটা কী করতে পারবে; সে নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।