দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে ছোট মূলধনের বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম। এর মধ্যে রেনউইক যগেশ্বর, স্টাইফ ক্র্যাফট, লিবরা ইনফিউশন, মুন্নু সিরামিকস, মুন্নু স্টার্ফলার, হাক্কানী পাল্প ও ওয়াটা কেমিক্যাল অন্যতম। এদিকে লভ্যাংশের ক্ষেত্রে মৌলভিত্তির কোম্পানি উত্তম হলেও সাম্প্রতিক দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই দর বাড়ছে বেশকিছু দূর্বল কোম্পানির শেয়ার দর। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণে কোম্পানিগুলোর কাছে ব্যাখ্যাও চেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ব্যাখ্যায় তারা জানিয়েছে, কোনো কারণ জানে না কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।

এমনকি কোম্পানির এখন নতুন কোনো বিনিয়োগ পরিকল্পনাও নেই। তারপরও বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানির দর বৃদ্ধি থামছে না। বরং দর বৃদ্ধির কারণে বিতর্কিত কোম্পানির তালিকা বাড়ছে। মূলত স্বল্প মূলধনি এসব কোম্পানির অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির নেপথ্যে কারসাজি চক্র সব সময়ই বাজারে থাকে। এটি আমাদের পুঁজিবাজারের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বল্প ও কম শেয়ারের এসব কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি করে লাভাবান হচ্ছেন তারা। শেয়ারদর অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছানোর পর বিক্রি শুরু করে সেই চক্র। পরে অতিরিক্ত দামে সেই শেয়ার কিনে পরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে পুঁজিবজার নিয়ে নেতিবাচক ধারণা যাচ্ছে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছে।

সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ইমেজ নষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। কাজেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিগুলোর ট্রেড (লেনদেন) সাসপেন্ড করতে পারে। তাহলে তারা একটি বার্তা পাওয়ার পাশাপাশি এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বলেও মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যারা বাজারে কারসাজি করে তারা এসব ছোট কোম্পানিকেই বেছে নেয়। কারণ খুব সহজেই অল্প পুঁজি দিয়ে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা যায়। ফলে এসব কোম্পানিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ তাদের।

এ বিষয় জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার যেভাবে বাড়ছে তা যৌক্তিক নয়। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম মৌল ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে কারা এসব কোম্পানির শেয়ার কিনছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। তিনি বলেন, ছোট মূলধনের কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি করা সহজ। অল্প পুঁজি দিয়ে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা যায়।

শেয়ারবাজার যখন মন্দা, ঠিক সেই সময় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে হাতেগোনা ছোট মূলধনী কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের। এ ক্ষেত্রে লোকসানি ও দুর্বল কোম্পানিও রয়েছে। গত ৬ মাসে এসব কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

কিন্তু কোম্পানির আয় বৃদ্ধি, ব্যবসা সম্প্রসারণ অথবা মূল্যসংবেদনশীল কোনো তথ্য না থাকলেও কয়েক মাস ধরেই দুর্বল কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ‘বি’ ও ‘জেড’ ক্যাটাগরির বেশ কিছু কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

অথচ ভালো ও মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে প্রতিনিয়ত মূল্য পতন হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কম সময়ে অধিক মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারের প্রতি ঝুঁকছেন। এতে স্বল্প মূলধনী, লোকসানি ও তুলনামূলক দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বেড়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট মূলধনী কোম্পানিকে টার্গেট করে কারসাজি চক্র এসব কোম্পানির ২০-৩০ হাজার শেয়ার কেনেন। তারপর কয়েকদিন আস্তে দাম বাড়ান। এরপর বিক্রির সময় দাম বাড়ানোর জন্য বেশি দামে আরো কিছু শেয়ার কেনেন। চক্রটি বাজারে গুজব ছড়ান যে, শেয়ারগুলোর দাম আরো বাড়বে। এই গুজবে কিছু বিনিয়োগকারীরা লাভের আশায় শেয়ারগুলো কেনেন। কারসাজি চক্র ঠিক তখনই তাদের হাতে থাকা শেয়ারগুলো বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে যান।

এদিকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠিত পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হাত গুটিয়ে রয়েছে।

একই অবস্থা দেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেরও। প্রতিষ্ঠান দু’টিও নিরব ভূমিকা পালন করছে। তারা শুধু এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা জানতে চেয়েছে। আর কোম্পানিগুলো তাদের উত্তরে জানিয়েছে দাম বাড়ার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবদেনশীল তথ্য নেই। কিন্তু সার্ভেইলেন্স সফটওয়ার থাকার পরও এই কারসাজি চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে না কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ।

দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, সব সময় স্মল পেইডআপ সম্পন্ন কোম্পানিতে কারসাজি হয়। এখানে অল্প শেয়ার কিনেই কারসাজি করতে পারে। তিনি বলেন, চক্রটি ‘জেড’ ক্যাটাগরির এ সব শেয়ারে লেগে থাকে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিৎ এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ পরিহার করা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কারসাজি করে দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিনিয়তই বাজারে কারসাজি বাড়ছে। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ফলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। পাশাপাপাশি কমছে পুঁজিবাজারে মর্যাদাও। তাই বাজারে স্বার্থে এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।