দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নতুন সরকার গঠনের এক মাসের মাথায় পুঁজিবাজার অস্থিতিরতার নেপেথ্যে কারা এ প্রশ্ন এখন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। সরকারের নানা আন্তরিকতার ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা।

কিন্তু নতুন বছরের ফেব্রুয়ারী মাস বিনিয়োগকারীদের হতাশ করছে। ফলে টানা দরপতনের কারনে বাজার মাঝে ঘুরে দাঁড়ালোও এর স্থায়িত্ব ছিল না। ফের সেই হতাশার বিরাজ আজও চলছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারছে না। ফলে আশা-নিরাশার দোলাচলে কেটেছে বিনিয়োগকারীদের। তার পরও বিনিয়োগকারীরা আশায় বুক বেঁধেছেন।

কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আশা দিন দিন নিরাশ করছে। পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে কারসাচি চক্র জড়িত। তাই একটি স্থিতিশীল বাজার প্রতিষ্ঠা এখন সর্বস্তরের মানুষের কাম্য। যা বর্তমানে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না। ভালো খবরেও সাড়া দিচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।

একটি সূত্র জানায়, বিশেষ একটি গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারের দরপতনকে উস্কে দিচ্ছে। ওই গোষ্ঠীটি বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে আরও বড় পতন হবে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছেড়ে দিতে প্রলুব্দ করছেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

সূত্রটি জানায়, এ গুজবের সাথে কয়েকটি কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহীরাও জড়িত। এছাড়া সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখনই তদন্ত করা উচিত। ২০১৯ সালের শুরুতে বাজার চাঙ্গাভাব শুরু হলেও ১ মাসের মাথায় টানা দরপতন শুরু হয়। দরপতনের নেপেথ্যে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স কারসাজি চক্র জড়িত বলে নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়। এ চক্রটি দরপতন বাজারকে উস্কে দেয়। ফলে এক মাসের মাথায় শেয়ার দর ১০০ শতাংশ কমেছে।

ফলে মুন্ন সিরামিকস ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স টানা দরপতন হয়। মুন্নু সিরামিকস ও মুন্নু স্টার্ফলাসের এ দরপতনে কোম্পানির পরিচালক থেকে শুরু করে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা জড়িত। বাজারে গুজব রয়েছে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্ট্যাফলার্স বড় দরবৃদ্ধির কারিশমা রয়েছে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা হাতে। এছাড়া এ কারসাজিতে মিজানুর রহমান জড়িত বলে সুত্রে জানা গেছে।

গত ১৩ মার্চ মুন্নু সিরামিকের মুনাফায় উল্লম্ফন ও শেয়ার দরে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ। মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। এর মূল উদ্দেশ্য কোম্পানির একটি করপোরেট পরিচালকের শেয়ার বিক্রি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিরুদ্ধে মুন্নুর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তুলেছেন তারা। তাদের বক্তব্য, কোম্পানির দেওয়া তথ্য কোনো যাচাইবাছাই না করে, অস্বাভাবিক মুনাফার বিষয়ে কোম্পানির কাছে কোনো ব্যাখ্যা না চেয়ে ওই তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ডিএসই।

উল্লেখ, গত ৩০ জানুয়ারি মুন্নু সিরামিক লিমিটেড তাদের সর্বশেষ অর্ধবার্ষিক (জুলাই’১৮-ডিসেম্বর’১৮) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে কোম্পানির মূল ব্যবসা (ক্রোকারিজ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি) থেকে মুনাফা দেখানো হয় ১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কারখানার পরিত্যক্ত বিভিন্ন জিনিস বিক্রি থেকে আয় দেখানো হয় ১৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

আগের বছর একই সময়ে অন্যান্য খাতে আয় ছিল ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এই খাতে আগের বছরের চেয়ে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বা প্রায় ৭০০ শতাংশ বেশি আয় দেখানো হয়। সব মিলিয়ে বছরের প্রথম দুই প্রান্তিক মুন্নু সিরামিকের ইপিএস দাঁড়ায় ৮ টাকা ১৩ পয়সা ও আগের বছর একই সময়ে ছিল ১ টাকা ৬৯ পয়সা।

মুন্নু সিরামিকের মুনাফার এই কৃত্রিম উল্লম্ফনে বাজারে শেয়ারের দামও তরতর করে বাড়তে থাকে। অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের আগের কর্মদিবস তথা ২৭ জানুয়ারি বাজারে মুন্নুর শেয়ারের দাম ছিল ২৪৯ টাকা ২০ পয়সা। গত ৪ মার্চ কোম্পানির করপোরেট পরিচালক মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের শেয়ার বিক্রির ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত তা বেড়ে ৪৪১ টাকা ৩০ পয়সা হয়। ঐ সময়ে এক মাসের ব্যবধানে শেয়ারটির দাম বাড়ে ৭৭ শতাংশ।

উল্লেখ, গত ৪ জানুয়ারি মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ৭ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। এর বড় অংশই ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাড়তি দামে পরিচালকের শেয়ার বিক্রি করার উদ্দেশ্য থেকেই কোম্পানিটি পরিত্যাক্ত বা ওয়েস্টেজ জিনিস বিক্রির নামে বাড়তি আয় দেখিয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে ছিলেন।

এদিকে কোম্পানির একটি সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনে মুন্নু সিরামিকের শেয়ারের পতনের পেছনে কোম্পানিটিতে অন্তকলহ প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকায় রয়েছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অর্থ পরিচালকের দ্বন্ধ। এই দ্বন্ধে এরইমধ্যে অর্থ পরিচালক মুন্নু সিরামিক থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্তের গুজ্জন ছিল।

অন্যদিকে, কোম্পানিটির বড় শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে কোম্পানি কর্তৃপক্ষেরও দ্বন্ধ দেখা দিয়েছে। এ কারণে কোম্পানিটির শেয়ার দরে বড় পতন দেখা দিয়েছিল।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের তথাকথিত কিছু বড় বিনিয়োগকারী যোগসাজস করে কোম্পানি দুটির শেয়ার দরে বড় বিপর্য়য় ঘটিয়েছে। বাজারকে অস্থির করার পেছনেও এসব বিনিয়োগকারীর হাত রয়েছে বলে তারা মনে করেন। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব অশুভ কারসাজি চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

নাম প্রকাশে অনিশ্চিুক এক সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পুঁজিবাজার অস্থিরতার নেপেথ্যে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্টার্ফলার দায়ী। কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা ও এক কারসাজি চক্র বেশি দর শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে গেছেন। বাজারে মুন্নু গ্রুপের বড় অঙ্কের টাকায় শেয়ার বিক্রির ফলে দরপতন তরান্বিত হয়।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা যায়, গত যা ৩ মার্চ তারিখে মুন্নু সিরামিকসের দর ছিল ৪৪১ টাকায়। এসময় বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে কোম্পানির পরিচালক ও কারসাজি চক্রের মুল হোতা মিজানুর রহমান শেয়ার বিক্রি শুরু করেন। শেয়ার বিক্রির ফলে দরপতন আরো তরান্বিত হয়। ফলে টানা দর কমতে কমতে গত বৃহস্পতিবার ২১৭ টাকায় নামলেও দিন শেষে ২৪৫ টাকায় লেনদেন হয়।

এদিকে ঐ চক্রটি আবার নতুন করে মুন্নু সিরামিকসের শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে শুরু করছেন বলে সুত্রটি জানায়। তারা নেতিবাচক ইপিএসের গুজব ছড়িয়ে নতুন করে শেয়ার কেনায় ধান্ধায় মগ্ন হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মুন্নু গ্রুপের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।