মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা পর দলে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। অভিযানের লক্ষ্যে সারা দেশে সাংগঠনিক সফরের জন্য দলের গঠিত আটটি বিভাগীয় টিম ঈদের পর পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করবে। ক্ষমতাসীন দলে ঠাঁই নেওয়া বহিরাগত ও নানা অপকর্মে জড়িতদের চিহ্নিত করে তখন দল থেকে বের করে দেওয়ার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একই সঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় পদ থেকে সরিয়ে জনপ্রিয়, ত্যাগী ও সৎ নেতাদের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সারা দেশে দলকে চাঙা ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে ঈদের পর থেকে মাঠে নামছে ক্ষমতাসীন দল।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র জানায়, দলের আটটি বিভাগীয় টিমের লক্ষ্য সারা দেশের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলন করা, পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন। একই সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতসহ অন্যান্য দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

অবশ্য অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া অনেক নেতার বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দল। কারো কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দৃশ্যমান না হলেও কোনো না কোনোভাবে শাস্তির আওতায় আসবেন অনুপ্রবেশকারীরা। তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের নেতাকর্মীদের তথ্যভান্ডার তৈরিতেও কাজ চলছে।

ঈদের পর শুদ্ধি অভিযান শুরু হলেও দলের আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগেই অভিযান শেষ করার পরিকল্পনা করছেন নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি, বঙ্গবন্ধুতনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী দলকে চাঙা করতে চলতি বছরের অক্টোবরেই জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। ওই মাসেই শেষ হবে আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতা জানান, টানা ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকায় দলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অনেক দলে অনুপ্রবেশ করেছে যারা বিভিন্ন সময়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। অনেক সুবিধাবাদী দলে ঢুকেছে আর এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিভিন্ন গণমাধ্যমকেও জানান।

সম্প্রতি সিলেটে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আগামী অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনের আগে সারা দেশে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন তথা তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার কাজ শুরু হয়েছে। তৃণমূল থেকে জেলা-উপজেলার সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করে জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করা হবে।’

অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলবে বলে দলটির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাও জানিয়েছেন। অনুপ্রবেশকারীদের যারা দলে জায়গা করে দিয়েছেন, সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধেও। পাশাপাশি দায়িত্বশীল কেউ জামায়াতিদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন বলে প্রমাণ হলে তার বা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলে এসে ঠাঁই নিলেও সাবেক জামায়াতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনুপ্রবেশকারীরা। এবারের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল প্রকট হয়ে দেখা দেয়। বেশির ভাগ উপজেলাতেই নৌকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন দলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার বিরুদ্ধে নানাভাবে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ওঠে।

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ এপ্রিল এসব নেতাকে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় দল। এ সিদ্ধান্ত থেকেও সরে এসেছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। আপাতত কারণ দর্শানোর চিঠি না পাঠিয়ে অভিযোগগুলো পুনরায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারো বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ এসেছে কি না, দলীয় কোন্দলের রেশ ধরে এক পক্ষ অন্যপক্ষের নেতার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছে কি না বা অভিযোগগুলোর পেছনে দলে অনুপ্রবেশকারীদের কোনো চক্রান্ত আছে কি না— সেসবও খতিয়ে দেখছে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ঢালাও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলে তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও শীর্ষ নেতাদের আশঙ্কা।

দলীয় সূত্রমতে, সম্প্রতি ফেনীতে মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির নাম উঠে আসে। হত্যা ঘটনার সন্দেহভাজন আরো কয়েকজনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা থাকা নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়।

এর আগে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাতজন খুনের ঘটনায়ও আওয়ামী লীগ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বলে দলটির অনেকে মনে করেন। দেশের আরো কয়েকটি এলাকায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির জেরে সংঘর্ষের খবর উঠে আসে গণমাধ্যমে। এসব ঘটনা সরকার ও আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। তাই দলে শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তবে টানা প্রায় সাড়ে দশ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের কোনো কোনো এলাকায় দলের মধ্যে বিভেদ, দ্বন্দ্ব, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এসব দূর করতে তৃণমূল থেকে দলকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে দলের এক যৌথসভায় সভাপতি শেখ হাসিনা দলকে তৃণমূল থেকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দেন। গত ১৯ এপ্রিল তিনি দলকে তৃণমূল থেকে ঢেলে সাজাতে পরিকল্পনার কথা জানান।

এদিকে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পরপরই অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন তিনি। যে কোনো দল সরকার গঠন করলেই সুর বদলিয়ে ভিড়ে যায় অনেক সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী। তারা সুযোগ-সুবিধা শিকারে মত্ত হয় আর বদনাম হয় সরকারের।

এমন বাস্তবতায় শুদ্ধি অভিযানের পথে হাঁটছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। এ জন্য একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রস্তুত করছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের কাছেই ফিরিয়ে দিতে চান দলীয় সভানেত্রী।

এ জন্য তালিকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে অনুপ্রবেশকারী এবং যাদের হাত ধরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাদের তালিকা করার কাজ শুরু হচ্ছে শিগগিরই। এ ছাড়া সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযানের মাধ্যমে বিতর্কিত কাউকে দলে ঢুকতে দেওয়া চলবে না এমন বার্তাও যাচ্ছে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাছে।

নেতারা বলছেন, গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়েছে। কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের হাত ধরে জামায়াতে ইসলামীর আমির থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ২ থেকে ৩ হাজার নেতা আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। একইভাবে বিএনপির নেতারাও আওয়ামী লীগ নেতাদের হাত থেকে ফুলের মালা নিয়ে নৌকায় উঠেছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতা, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ মাদক মামলা।

মূলত মামলা থেকে বাঁচতেই তাদের আওয়ামী লীগে যোগদান। তবে তাদের এ যোগদানকে প্রথমে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও হঠাৎ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতের যোগ দেওয়াকে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন দলটির হাইকমান্ড। দলটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের ইমেজ ক্ষুণ্ন করছেন অনুপ্রবেশকারীরাই। কিছু আসে স্বার্থ হাসিলের মতলবে, আবার কেউ কেউ নিজের দোষ ঢাকতে এবং শাস্তি থেকে বাঁচতে। নেতারা মনে করেন, দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের মূল কারণও এসব অনুপ্রবেশকারী।

ত্যাগী ও দীর্ঘ সময় দলকে সেবা দেওয়া নেতাদের বঞ্চিত করে অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় পদ দেওয়ায় অনেক স্থানেই বিপত্তি বেধেছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত থেকেও ভয়ঙ্কর নব্য আওয়ামী লীগ। এরা সুযোগসন্ধানী। এদের চিনে রাখতে হবে।

যাদের কখনো সভা-সমাবেশে দেখিনি তারাও এখন আওয়ামী লীগ করে। এদের থেকে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে। একইভাবে দলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার তাগিদ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ।তিনি গত রবিবার এক আলোচনা সভায় বলেছেন, দলে অনুপ্রবেশকারীরা বিশৃঙ্খলা ঘটায়। এদের চিহ্নিত করতে হবে।

দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের নেতারা জানিয়েছেন, আগামী এপ্রিলে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন শুরু হবে। এর মাধ্যমে দলে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হবে। অনুপ্রবেশকারীরা দলের পদপদবিতে থাকলে তাদের বাদ দেওয়ার পাাশাপাশি যারা তাদের পুনর্বাসন করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারা দেশে আওয়ামী লীগের অন্তর্দলীয় কোন্দলের যেসব ঘটনা ঘটছে তার অধিকাংশই অনুপ্রবেশকারীরা ঘটাচ্ছেন বলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে তথ্য রয়েছে। সে কারণেই তিনি এখন শুদ্ধি অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু অনুপ্রবেশকারীই নয়, স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মী এখন সুবিধাবাদী রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছেন। দলের শীর্ষ নেতা মনে করেন এটা অশনিসংকেত।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে একশ্রেণির লোক আছে, যখন যে সরকার তখন সে সরকারের সঙ্গে থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের দলেও কিছু লোক ঢুকে পড়েছে; যারা এখনো মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাস করে না। স্বাধীনতাকে মানে না। এদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। কারণ এরাই দলের বদনাম করে থাকে।’

সূত্র জানান, আগামী শুক্রবার বিকালে দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক ডেকেছেন দলীয় সভানেত্রী। ওই বৈঠকে তৃণমূলে শুদ্ধি অভিযান থেকে শুরু করে আগামী অক্টোবরে দলের জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি, মুজিববর্ষ পালনে দলীয় কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘সংগঠনে অনুপ্রবেশকারী, পরগাছা, আগাছার ব্যাপারে আমাদের দলীয় সভানেত্রীর একটি জরিপ আছে। দলের সকল পর্যায়ের নেতার প্রতি নেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের কাউকে দলে না ভেড়াতে। যদি কেউ ভেড়ান সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারী কেউ দলে পদপদবি পেয়েছেন এমন নজির নেই। নিয়মিত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়েই অনুপ্রবেশকারী, পরগাছা উপড়ে ফেলা হবে।’