দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রবিবার (১৪ জুলাই) সকাল পৌনে ৮টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম খান এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য নাম। প্রতাপশালী সেনাশাসক থেকে রাজনীতিতে এসে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজেকে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে রাখেন। ক্ষমতাকে ঘিরে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির টানাটানি ছিল চোখে পড়ার মতো।

‘৯০-পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনের আগে জোট-মহাজোটের রাজনীতিতে এরশাদের ছিল আলাদা কদর। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই এরশাদকে পক্ষে রাখতে চাইত। তিনি ছিলেন রীতিমতো ‘হট কেক’।

পল্লীবন্ধু এরশাদের একসময়ে রাজনৈতিক সহচররা তাকে ছেড়ে চলে গেলেও কখনই নিঃসঙ্গতায় ভোগেননি তিনি। বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্রে জাতীয় পার্টিতে কয়েক দফা ভাঙন দেখা দিলেও জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব বিলীন হয়নি। বরং সবশেষ দুই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে ছিল। দল গঠনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বাঘা বাঘা নেতারা জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।

এরশাদের ৯ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে পরে অনেকে উপরাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-এমপি হন। সময়ের ব্যবধানে এরশাদের দুর্দিনে তারা বসন্তের কোকিলের মতো জাতীয় পার্টি ছেড়ে যান। দলছুটদের কেউ কেউ আজ প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নিজেদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেকে জটিল রাজনীতির চোরাগলিতে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছেন, নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। প্রবীণদের কেউ কেউ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে।

এদের বেশির ভাগ বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের রাজনৈতিক সমীকরণে জড়িয়ে যান তিনি। ক্ষমতা ও জোটের রাজনীতিতে এরশাদ হারিয়েছেন দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে, নিজের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের। যাদের উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই ‘সুযোগ-সুবিধা’র প্রশ্নে তাকে ছেড়ে চলে যান।

বিগত ৪০ বছর বাংলাদেশের রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা জানান, এরশাদের জাতীয় পার্টির বেশিরভাগ নেতার ঠাঁই হয়েছে বিএনপিতে। পুরনো আওয়ামী লীগারদের মধ্যে যারা এরশাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ বিএনপিতে গেলেও বেশিরভাগই আওয়ামী লীগে ফিরেছেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘুরে শেষ জীবনে এসে তাদের কারও কারও পুনর্বাসন হয়েছে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তারকাখ্যাত অনেক নেতা একসময় জাতীয় পার্টি থেকে আজ বিএনপি-আওয়ামী লীগে আছেন।

আর তাদের মধ্যে রয়েছেন- ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, এমএ মতিন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কেএম ওবায়দুর রহমান, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, এমএ মুহিত, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আনোয়ার জাহিদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জুর। এদের বেশিরভাগই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের যোগ দিয়ে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। দু-একজন আলাদা দল গঠন করেন।

দেখা গেছে, ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ও দেখভাল করেছেন। তিনি এরশাদ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি পদেও ছিলেন কিছু দিন। মওদুদ পরে বিএনপিতে যোগ দেন। বর্তমানে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তিনি। ২০০১ সালে জোট সরকারে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব প্রফেসর এমএ মতিনও বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এরশাদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ পরে নতুন জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তবে তিনি অন্য কোনো দলে যোগ দেননি। বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। তিনি কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেন। ’৮৮ সালে এরশাদ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।

এরশাদ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ছিলেন। দলের মহাসচিব পদেও ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি মহাজোটে আছেন। জেপি নামে দল গঠন করে গত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন। আর মঞ্জুর জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলামও একসময় এরশাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন।

এরশাদের জাতীয় পার্টির অন্যতম নেতা ছিলেন ঢাকার প্রথম মেয়র নাজিউর রহমান মঞ্জুর। এরশাদ যখন জেলে তখন তিনি পার্টির মহাসচিব ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আগে এরশাদ চার দলীয় জোট ছেড়ে দিলে তিনি এরশাদকে ছেড়ে চলে যান। বিজেপি নামে দল গঠন করে বিএনপির জোট সঙ্গী হন।পরে তিনি মারা যান।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত এরশাদের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের এক সময়কার প্রভাবশালী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এরশাদের জাতীয় পার্টি করেন দীর্ঘদিন। তিনি এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি এরশাদকে ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান।

এ ছাড়া, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠাকালে পার্টির চেয়ারম্যান হন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মহাসচিব নিযুক্ত হন অধ্যাপক এমএ মতিন। এমএ মতিন এরশাদকে রেখে পরে বিএনপি জোটে ভেড়েন। ওই সময় ৬০১ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। ৫৭ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সচিব হন সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ।

পরে তিনি ১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং বিএনপিতে সক্রিয় হন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তাকে স্পিকার নির্বাচিত করে। তিনি মারা গেছেন।

এরশাদ জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠাকালে ২১ সদস্যের প্রেসিডিয়াম, ৫৭ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটিসহ ৬০১ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটির ঘোষণা দেয়া হয়। ২১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামের মধ্যে ১৮ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- মিজানুর রহমান চৌধুরী (আসেন আওয়ামী লীগ থেকে), মওদুদ আহমদ (আসেন বিএনপি থেকে, পরে আবার জাপা ছেড়ে বিএনপি), কাজী জাফর আহমেদ (পৃথক দল), সিরাজুল হোসেন খান, রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (বিএনপিতে যোগ দেন), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।

আর এদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন। সবশেষ ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগ দেন। আমৃত্যু তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এরশাদ সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছ। বর্তমানে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (একাংশ) চেয়ারম্যান।

কুমিল্লার সাবেক সংসদ শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদও এরশাদের দলে ছিলেন। তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।

বর্তমান সরকারের ডেপ-স্পিকার ডা. টিআইএম ফজলে রাব্বি চৌধুরী, মোস্তফা জামাল হায়দারসহ অনেকে একসময় এরশাদের সঙ্গে ছিলেন। পরে তারা দলবদল করেন।