দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার নিয়ে আতঙ্ক কাটছে না। সারাবিশ্বেই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজার হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা। কিন্তু বাংলাদেশে ঝুঁকি আর অনাস্থার বড়ো উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজার।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ৬ মাসে বাজার মূলধন কমেছে ৪৩ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ২০ জানুয়ারি ডিএসইতে বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ১৬ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এ বাজার মূলধন ২২ জুলাই নেমে আসে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকায়। বিষয়টি অনেক অস্বাভাবিক।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো কাজে আসেনি। কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই বাজারে সূচকের পতন আবার উল্লম্ফন কারসাজিরই ইঙ্গিত বহন করে। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীরা যখন আস্থা হারিয়ে ফেলেন, তখন বড়ো পতন হয় শেয়ারবাজারে। আতঙ্কিত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিতে থাকেন। এর ফলে পতন আরো দ্রুত হয়। পুঁজিবাজারে সা¤প্রতিক দরপতনের হাজার হাজার কোটি টাকা পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও করেছেন। পুঁজিবাজারে টানা পতনের প্রতিবাদে এ মাসের শুরুর দিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও করেছেন বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৫ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপিও দেন তারা।

তাদের মতে, ২০১০ ও ১৯৯৬ সালে যে চক্র শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সরিয়েছে, তারাই আবার বাজারে সক্রিয় হয়েছে। কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা আবার সক্রিয় হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দরপতনের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

আস্থাহীনতাই দরপতনের বড়ো কারণ। আর এ আস্থাহীনতার মূল কারণ নীতিনির্ধারকদের আশেপাশে প্রশ্নবিদ্ধ ইমেজের কিছু লোকজনের উপস্থিতি রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এদের কারণে ভীতসন্ত্রস্ত। না জানি আবারও বড়ো ধস ঘটিয়ে দেয় এরা। এদের কেউ কেউ আবার ইতিপূর্বেকার কারসাজির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন বলে সূত্র জানায়।

সূত্র মতে, যে লোকগুলো বাজারে আতঙ্ক, সেই লোকগুলোই যদি নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখে কিংবা নীতিনির্ধারকদের পাশে থাকে, তাহলে বাজারের প্রতি আস্থা আসবে কিভাবে? ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে কারসাজির ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে সময় কারসাজির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমাদের সুপারিশে প্রভাবশালীদের নাম এসেছিল কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরবে কি করে?

তিনি বলেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডি-মিউচুয়ালাইজেশন (ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথক করা) করা হলেও এটা আশিংক বাস্তবায়ন হয়েছে। এর থেকে সঠিক ফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ডিএসইতে নতুন করে কোনো মেম্বারশিপ দেওয়া হচ্ছে না। আগে যারা ছিল তারাই কোটারি করে বিনিয়োগ করছে। এরাই কোনো শেয়ারে দাম অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে আবার কোনো শেয়ারের দাম ফেলে দিচ্ছেন।

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন নতুন বড়ো প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বাজারে যারা আসছে তারা খুবই দুর্বল প্রতিষ্ঠান। এ বাজারে যতদিন বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার নিয়ে আসা না যাবে ততদিন বিনিয়োগকারীরাও আস্থা ফিরে পাবে না।

বাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদেরই শুধু নয়, বড়ো কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও আস্থার অভাব রয়েছে। যে কারণে চলতি বছরের শুরুতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরাতে শেয়ারবাজার এক্সপোজার সীমা সংশোধন করা হয়। তথাপি প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে থাকার কারণে শেয়ারবাজারে অর্থের প্রবাহ কমেছে। ২০১১ সালে বাজারে শেয়ারের ক্রয় চাহিদা বাড়াতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের এককভাবে দুই শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।

আট বছরেও এ বিধান পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি বিএসইসি। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া সরকারের ৯০০ কোটি টাকাও কাজে আসেনি। কেউ ওই ঋণ নিতে আগ্রহী ছিল না। নতুন করে সরকার ওই অর্থকে পুনরায় ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে প্রদান করেছে। কিন্তু এর সুফল বাজারে নেই।

বাজারে বিনিয়োগকারীদের অন্যতম দাবি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনকে সরিয়ে দেয়া। তাদের মতে, এই চেয়ারম্যানকে রেখে বাজার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিষয়টি সরকারের নজরে এলেও একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি বিষয়টি দেখভাল করছেন বলে সূত্র জানায়। তবে বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে বিনিয়োগকারীরা আরো সংগঠিত হচ্ছে।

এদিকে, গত ছয় মাসে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন এমন ২ হাজার বিনিয়োগকারীর তথ্য চেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গঠিত তদন্ত কমিটি। বড়ো দরপতনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। শীর্ষস্থানীয় ২০টি ব্রোকারেজ হাউজ ও ২০টি মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে এই ২ হাজার গ্রাহক বা বিনিয়োগকারীর তথ্য চাওয়া হয়।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যভুক্ত শীর্ষ ২০ ব্রোকারেজ হাউজের গত ছয় মাসে বিক্রির দিক থেকে শীর্ষে থাকা ৫০ জন করে মোট ১ হাজার জনের এবং একইভাবে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ রয়েছে এমন ২০ মার্চেন্ট ব্যাংকের ৫০ জন করে মোট ১ হাজার জনের শেয়ার বিক্রি, টাকা জমা, টাকা উত্তোলনসংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যেসব ব্রোকারেজ হাউজের নিজস্ব বিনিয়োগ বা ডিলার হিসাব রয়েছে, তাদেরও একই ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে।

গত ২১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুলাই সময়কালে যেসব ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি হয়েছে, মূলত তাদের কাছ থেকেই তথ্য চাওয়া হয়েছে। ২২ জুলাই ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়। গত ২১ জানুয়ারি দেশের ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৮৫৯ পয়েন্টে।

আর ২২ জুলাই তা কমে নেমে আসে ৪ হাজার ৯৬৬ পয়েন্টে। এ সময়ে ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে ৮৯৩ পয়েন্ট। এ পতনকে অস্বাভাবিক মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। তাই এ সময়কালে যেসব প্রতিষ্ঠান ও বড়ো বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করেছেন সেখানে কোনো অনিয়ম বা কারসাজি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে মূলত এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে।