দেশ প্রতিক্ষণ, চট্টগ্রাম: যমুনা অয়েলের পতেঙ্গা গুপ্তখাল প্রধান ডিপোতে জাহাজ থেকে খালাসের পর ৬৫ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল চোরাইভাবে বিক্রির চেষ্টা ফাঁস হয়েছে। এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঘটনা তদন্তে ১৫ আগস্ট সরকারি ছুটির দিনেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ও যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এদিকে, একের পর এক তেল চুরির ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে রাষ্ট্রীয় তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড।

জানা যায়, গত ১০ আগস্ট যমুনা ডিপোর ডলফিন জেটিতে আসা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমটি পামির থেকে গুপ্তখাল ডিপোতে খালাসের পর প্রায় ৬৫ হাজার লিটারের অধিক ফার্নেস অয়েল চোরাইভাবে বিক্রির প্রস্তুতির ঘটনা বৃহস্পতিবার সকালে ফাঁস হয়। এসময় ডিপোর টার্মিনাল ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন যমুনা অয়েল ডিপোর প্রধান কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) জসিম উদ্দিন। তিনি প্রধান কার্যালয়ের মূল দায়িত্ব ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে গুপ্তখাল ডিপোতে গত মে মাস থেকে টার্মিনাল ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন।

সরকারি হিসেবে, প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ৪২ টাকা। সেই হিসেবে ৬৫ হাজার লিটারের দাম ২৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বিষয়টি জেনে ১৫ আগস্ট সরকারি ছুটির দিনে জরুরিভাবে ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. আবু হানিফকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিপিসি। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্য হলেন বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. জাহিদ হোসেন। একইসঙ্গে যমুনার গুপ্তখাল ডিপো থেকে সব ধরনের তেল সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দেয় বিপিসি। ফলে জাহাজ থেকে অতিরিক্ত তেল ডিপোর ট্যাংকে খালাস সম্ভব হলেও ডিপো থেকে তেল পাচারের অভিযানটি ব্যর্থ হয়ে যায়।

অন্যদিকে, যমুনা অয়েল কোম্পানিও আরেকটি কমিটি গঠন করেছে। যমুনা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অডিট) মোহাম্মদ খসরূ আজাদকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ম্যানেজার (অডিট) মো. হেলাল উদ্দিন ও উপব্যবস্থাপক আবুল মনছুর।

এ ব্যাপারে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, যমুনা অয়েল ডিপোর অভিযোগ তদন্তে বিপিসি থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি শুক্রবার ঘটনাস্থলে যাবে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গতকাল সকাল সোয়া ১১টায় বিপিসির তদন্ত কমিটির প্রধান মো. আবু হানিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বাসায় অবস্থান করছেন এবং পারিবারিকভাবে একটি ঝামেলায় আছেন জানিয়ে বিষয়টি এডিয়ে যান।

তবে, গুপ্তখাল যমুনা অয়েল ডিপোর এক কর্মকর্তা জানান, মো. আবু হানিফের নেতৃত্বে বিপিসির তদন্ত দল শুক্রবার সকাল নয়টায় যমুনা অয়েল ডিপোতে আসেন। জুমার সময়ে নামাজ ও দুপুরের খাবারের জন্য ডিপোর বাইরে গেলেও দুটার দিকে পুনরায় ডিপোতে আসেন। বিকেল চারটা ২০ মিনিটে বিপিসির তদন্ত দল ডিপো ত্যাগ করে। এসময় আবু হানিফ দুটি আলাদা প্যাকেটে বেশ কিছু ডকুমেন্ট সাথে করে নিয়ে যান।

অন্যদিকে, গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে গুপ্তখালস্থ ঘটনাস্থলে যান যমুনা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অডিট) মোহাম্মদ খসরূ আজাদের নেতৃত্ব তদন্ত দল। তারা দুপুর আড়াইটার দিকে যমুনা অয়েল ডিপো ত্যাগ করেন বলে জানান ডিপোর ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বিকালে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আনচারী ব্যক্তিগত অসুস্থতার কথা জানিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এদিকে, তেল চুরির বিষয়ে জানতে যমুনা অয়েল ডিপোর টার্মিনাল ম্যানেজার জসিম উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

গুপ্তখালে যমুনার প্রধান ডিপোতে তেল চুরির ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর এমটি রাইদা ও এমটি মনোয়ারা নামে দুটি জাহাজে করে অতিরিক্ত ডিজেল ভর্তি করে পাচারের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে এমটি মনোয়ারায় অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৭৮২ লিটার এবং এমটি রাইদায় ৫০ হাজার ৯০০ লিটার ডিজেল ভর্তি করে পাচার করা হয়।

ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি যমুনার পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব তেল পাচারের অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত পাঁচ কর্মকর্তার কাছ থেকে পাচারকৃত ১ লক্ষ ৫১ হাজার ৮৯০ লিটার ডিজেলের মূল্য আদায়ের জন্য পদক্ষেপ নেয় যমুনা অয়েল কোম্পানি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপো সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সরাসরি দালিলিকভাবে আসা তেল চুরি করা সম্ভব নয়। তবে জাহাজ থেকে তেল নেওয়ার সময় তাপমাত্রাসহ কিছু ‘ফ্যাক্টরের’ কারণে তেলের পরিমাণ কম-বেশি হয়ে যায়। জাহাজে আসা তেল ইনভয়েস থেকে বেশি হলেই অতিরিক্ত তেল অনেক সময় অবৈধভাবে বিক্রি করে দেয় ডিপোর দায়িত্বে থাকা একটি সিন্ডিকেট। মূলত জাহাজে গেজিং (তেল মাপা) করার সময় তেলের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কোনো কারণে জাহাজে তেল ইনভয়েসের অতিরিক্ত হলে তা বিপিসির সম্পদ হওয়ার কথা।

কারণ, বিপিসিই ঋণপত্র খুলে বিদেশ থেকে তেল আমদানি করে থাকে। কিন্তু ডিপোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা বিপিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে এসব অতিরিক্ত তেল অন্যত্র পাচার করেন। আবার সিস্টেম লস দেখিয়েও তেল চুরি হয়। মূলত সনাতনী গেজিং পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগেই তেল চুরির ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, বিপিসির ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তেল চুরির সাথে জড়িত অভিযুক্তরা প্রতিবারই পার পেয়ে যান।