দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার সুচকের উঠানামার মধ্যে দিয়ে চলছে। বাজারের টানা দরপতনে বাজার নিয়ে দু:চিন্তায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। তারপরও স্থিতিশীল বাজার দেখার অপেক্ষায় বিনিয়োগকারীরা। সরকারের নানা আন্তরিকতার ফলে বাজার স্বাভাবিক হতে শুরু করছে। তবে এর মধ্যে ও মাঝে মধ্যে সুচকের উঠানামা করলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তবে উঠানামা বাজারের মধ্যে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর আকাশচুম্বী বাড়ছে। আবার কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর বিনিয়োগের উপযোগী।

তবে দুর্বল মৌল ভিত্তি শেয়ারের দরবৃদ্ধিতে বিনিয়োগকারীরা দু:চিন্তায় পড়েছেন। তাই বাজারের স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। তবে বিনিয়োগকারীরা কোন খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে বাজারে নানা গ্রুপ রয়েছে এরা বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করছে।

নিয়মবহির্ভুতভাবে যে সব কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা। মূলত পুঁজিবাজারে কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে যারা গ্যামব্লিংসহ নানারকম নিয়মবহির্ভুত কাজের সাথে জড়িত। তারাই কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, একটি প্রতিষ্ঠানের মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) বিবেচনা করে কোম্পানিটির শেয়ার দরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। তাঁদের মতে, যে কোম্পানির পিই রেশিও যত বেশি, সে কোম্পানি তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যদি পিই রেশিও নেগেটিভ হয় তবে এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই শ্রেয়।

কিন্তু যে সকল কোম্পানির পিই রেশিও মার্কেট পিই রেশিওর তুলনায় কম, সেসকল কোম্পানিতে বিনিয়োগ উত্তম।। আর পিই ২৫ এর নিচে থাকা কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ খুবই উত্তম বলে মনে করা হয়।

এদিকে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে তিন কারনে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি ঝোঁক রয়েছে বিনিয়োগকারীদের। এর মধ্যে পরিচালক মুনাফার খবরে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি একটু বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা এমনই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের প্রতিবেদকের কাছে।

তারা বলেন, পুঁজিবাজারের গতি ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকের খাতের শেয়ারের প্রতি কদর বাড়ছে। সামনে আরো বাড়বে। কারণ অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর কাছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রতি রয়েছে ব্যাপক আস্থা। যদিও পুঁজিবাজারের মন্দা সময়ে এ খাতের প্রতি আস্থা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে আবার এ খাতের শেয়ারের প্রতি ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা জানান, পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ পুঁজিবাজার উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি বাড়াতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এ খাতের শেয়ার এখনো কিছুটা বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত। পাশাপাশি রয়েছে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ আস্থাভাজন। তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম।

তারা আরো জানান, ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন এবং শেয়ার সংখ্যা বেশি। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এ খাতকে বিনিয়োগ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আবার কোম্পানিগুলোর লেনদেন ও দর ওঠানামা অনেকটাই স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। অন্যান্য কোম্পানির মতো ঢালাওভাবে এ খাতের শেয়ার দর উত্থান-পতন হয় না।

এদিকে পরিচালন মুনাফার খবরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোতে দীর্ঘদিন পর সুবাতাস ফিরেছে। সম্প্রতি চাঙা হতে শুরু করেছে এ খাত। যে কারণে অন্যসব খাতের তুলনায় এ খাতের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন মুনাফা বছরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমানে এ খাতের অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর তুলনামূলক অনেক কম। সেই তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা এবং লভ্যাংশ প্রদানের হারও সন্তোষজনক। অন্যদিকে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। মূলত সে কারণেই এসব কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এ মুনাফা ধরে রাখতে পারবে কি না সেটা দেখার বিষয়।

কারণ পরিচালন মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এটি ব্যাংকের চূড়ান্ত হিসাব তথ্যও নয়। ব্যাংকের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে চূড়ান্ত হিসাব তথ্য পাওয়া যাবে। এর থেকে ব্যাংকের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ শেষে এবং করের টাকা পরিশোধের পর নিট মুনাফা বেরিয়ে আসে।

এ বিষয় ব্রোকারেজ হাউজ মালিকদের সংগঠন ডিবিএ’র সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগকারী সব সময় ভালো শেয়ারের সঙ্গে থাকতে চান। সার্বিক বিবেচনায় এখনও অধিকাংশ ব্যাংক শেয়ারে বিনিয়োগের অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক দরপতনে এসব শেয়ারের দর কমে গেছে। হয়তো সে কারণেই ব্যাংক শেয়ারের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

নিম্নে সর্বনিম্নের পিই সম্পন্ন ব্যাংক খাতের ১০ কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা গেছে। ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও আলআরাফাহ ব্যাংক।

এদিকে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সূত্রে পাওয়া পরিচালন মুনাফার তথ্যে দেখা যায়, মুনাফায় সবার ওপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। চলতি ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে এক হাজার ২২৩ কোটি টাকা।

২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে এ ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল এক হাজার ২১ কোটি টাকা। এর পরেই সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড ৫০৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। এ ব্যাংকটির আগের বছরের ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা ছিল ৪৫৫ কোটি টাকা।

একইভাবে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৪০৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২৬০ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৭০ কোটি টাকা। এদিকে ব্যাংক শেয়াররের মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও এখনও ৯-এর নিচে অবস্থান করছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যে কোনো খাত বা কোম্পানির ক্ষেত্রে এ রেশিও বিনিয়োগের উপযোগী। কোনো প্রতিষ্ঠানের পিই ২০-এর ওপরে চলে গেলে ধীরে ধীরে ওই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর ৪০-এর বেশি পিই হলে ওই প্রতিষ্ঠান খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে কারণে এ ধরনের কোম্পানির মার্জিন ঋণ সুবিধা বন্ধ থাকে।