দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর জন্য আলাদা ক্যাটাগরি করতে সম্প্রতি দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর ভিত্তিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক আলোচনাও সম্পন্ন করেছে। এ আলোচনায় ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর জন্য আলাদা ক্যাটাগরি গঠনের ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। এসব প্রশ্নের সমাধানে ডিএসই ও সিএসই কর্তৃপক্ষ বিএসইসির মতামত জানতে চায়। এ লক্ষ্যে তারা কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষকে কয়েকটি ইস্যুতে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুলেশন অনুযায়ী ‘এ’, ‘বি’, ‘জি’, ‘এন’ ও ‘জেড’ এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারকে স্থান দেয়া হয়। এখন ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন ক্যাটাগরি গঠন করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই লিস্টিং রেগুলেশনে পরিবর্তন আনতে হবে।

এছাড়া নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির শেয়ারের সেটেলমেন্ট পিরিয়ড নির্দিষ্ট। এ অবস্থায় নতুন ক্যাটাগরি গঠন করা হলে নতুন সেটেলমেন্ট পিরিয়ড নির্ধারণের বিষয়টিও চলে আসে। ‘এ’ ক্যাটাগরির শেয়ারগুলোর সেটেলমেন্ট লেনদেন-পরবর্তী দুই কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পন্ন করতে হয়। অন্যদিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ারগুলোর সেটেলমেন্ট পিরিয়ড ১০ কার্যদিবস। এ অবস্থায় নতুন ক্যাটাগরিতে স্থান পাওয়া কোম্পানিগুলোর সেটেলমেন্ট পিরিয়ডেও পরিবর্তন আনা হবে, নাকি সেগুলোকে কেবল পৃথক একটি তালিকায় স্থান দিয়ে সেটেলমেন্ট পিরিয়ড আগের মতোই বহাল রাখা হবে, সে বিষয়ে অস্পষ্ট অবস্থায় রয়েছে ডিএসই ও সিএসই কর্তৃপক্ষ।

দেখা গেছে, স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থ এমন তালিকাভুক্ত কোম্পানি ‘এ’, ‘বি’ ও ‘জেড’ এই তিন ক্যাটাগরিতেই রয়েছে। যেসব কোম্পানি নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করে ও সর্বশেষ হিসাব বছরে ১০ শতাংশ বা তার বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করে, সেসব কোম্পানির শেয়ার ‘এ’ ক্যাটাগরিতে স্থান পায়। যারা নিয়মিত এজিএম করে, কিন্তু সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে পারে না, তাদের স্থান হয় ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। আর যেসব কোম্পানি সময়মতো এজিএম করতে ও কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ অথবা টানা ছয় মাসের বেশি কার্যক্রম বন্ধ থাকে অথবা রাজস্ব সঞ্চিতি সমন্বয়ের পর যাদের সমন্বিত লোকসানের পরিমাণ পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে বেশি, তাদের স্থান হয় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে। অর্থাৎ এসব ক্যাটাগরির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অনেকটাই বোঝা যায়।

কিন্তু যদি স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থতার কারণে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ারগুলোকে বিএসইসির নির্দেশনা অনুসারে নতুন একটি ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়, তাহলে কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা নিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এসব বিষয়ে অস্পষ্টতা দূর করতে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারা ঈদুল আজহার ছুটির আগে বিএসইসির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করেছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত কার্যদিবস না থাকায় এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। ছুটির পর দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হলে বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই কর্তৃপক্ষের মধ্যে আরো আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বরাবর পাঠানো চিঠিতে বিএসইসি বলেছে, ২১ মে কমিশনের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুসারে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ অবস্থায় তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর জন্য দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকে তাদের সংশ্লিষ্ট ট্রেডিং বোর্ডে আলাদা একটি ক্যাটাগরি গঠনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো।

বিএসইসির ৬৮৭তম কমিশন সভায় উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ কোম্পানির বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এর মধ্যে রয়েছে: তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত অন্যান্য পরিচালক ও উদ্যোক্তারা সম্মিলিতিভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ না করলে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কোম্পানির শেয়ার বিক্রয়, হস্তান্তর কিংবা বন্ধক কার্যকর হবে না। তবে ঋণখেলাপি হলে বন্ধকি শেয়ার বাজেয়াপ্ত কিংবা মারা গেলে শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে।

উদ্যোক্তা-পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ না করলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি রাইট শেয়ার অফার, রিপিট পাবলিক অফার (আরপিও), বোনাস শেয়ার, কোম্পানির একত্রীকরণ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে মূলধন বাড়াতে পারবে না। তাছাড়া উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর জন্য দুই স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের ট্রেডিং বোর্ডে আলাদা একটি ক্যাটাগরি গঠন করবে।

কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ারধারণের বিপরীতে একজন ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে মনোনীত করতে পারবে। ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ারধারণে ব্যর্থতায় পরিচালকের পদ শূন্য হওয়ার কারণে যে সাময়িক শূন্যতা তৈরি হবে, তা ২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে এমন শেয়ারহোল্ডারদের মধ্য থেকে পরিচালকের পদ শূন্য হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পূরণ করতে হবে।

তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ ও এককভাবে ২ শতাংশ শেয়ারধারণের বিষয়টি নিয়ে ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত নোটিফিকেশন জারির পর থেকেই বিবাদ চলে আসছে। বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা-পরিচালক নোটিফিকেশনটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। তবে আইনি লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগের রায় বিএসইসির পক্ষে আসে। এরপর ন্যূনতম শেয়ারধারণের বিষয়টি পরিপালনে বিএসইসির পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোকে তাগাদা দেয়া হলেও এখনো অর্ধশতাধিক কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকের কাছেই ন্যূনতম শেয়ার নেই।