এফ জাহান ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে থাকা কোনো কোম্পানির পরিচালক হতে চাইলে থাকতে হবে কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ার। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসি আইনী কড়াকড়ি আরোপ করায় পর্যাপ্ত শেয়ার না থাকা পরিচালকদের নতুন করে প্রচুর শেয়ার কিনতে হবে। এতে করে পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনার হার ও বিনিয়োগ দুটোই বাড়বে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

তবে শুধুই আইন সংশোধনই নয়, তা প্রয়োগেও বিএসইসিকে তৎপর হতে বলছেন বিশ্লেষকরা। কারন কাগজে কলমে আইন হলে চলবে না এর বাস্তবায়ন হতে হবে। তাছাড়া আইন ভঙ্গ করে অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করছেন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা। বারবার এমন অনিয়মের অভিযোগে এবার কঠোর অবস্থানে গেল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

সংশোধিত আইনে বলা হচ্ছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার না রাখলে বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে কোম্পানি। আর এককভাবে কমপক্ষে ২ শতাংশ না থাকলে ছাড়তে হবে পরিচালকের পদ। এমন কড়াকাড়ি আরোপে বাজারে বাড়তে পারে বিনিয়োগ।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারে বিভিন্ন উপায়ে কারসাজি হচ্ছে, কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। বিশেষ করে যারা সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ বা এককভাবে দুই শতাংশ শেয়ার ধরে রাখছে না, তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইনে কী বলা আছে, সেটি পরিষ্কার করে বলতে হবে এবং তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। আবার এদের শাস্তি না দিয়ে বিভিন্নভাবে কোম্পানিগুলোর বোনাস শেয়ারে বিভিন্ন ধরনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। যারা বাজারকে অস্থিতিশীল করছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কয়েকদিন আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি কোম্পানি অবসায়ন করা হয়েছে। ওই কোম্পানি থেকে যারা ঋণ নিয়েছে এবং পরে ঋণকৃত অর্থ ফেরত না আসায় কোম্পানিটি একপর্যায়ে তারল্য সংকটে পরে। ফলে কোম্পানিটি অবসায়ন করা হয়েছে। যারা ঋণ দিয়েছে এবং যারা অর্থ ফেরত দেয়নি তারাই মূল অপরাধ করেছে। কথা হচ্ছে যারা অর্থ দিয়েছে ও নিয়েছে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিনিয়োগকারীরা। এর ফলে বাজারে একটি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ওই সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত নতুন নতুন অনেক আইন হচ্ছে। আইন তৈরি করা কঠিন কোনো কাজ নয়। যে আইনটি করা হচ্ছে সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি নতুন নতুন আইন করে যায়, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে না পারে তাহলে আইন করে লাভ হবে না। দেখা যায় যখন বাজারে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই আইন তৈরি করা হয়। এভাবে বাজার স্থিতিশীল করা যাবে না।

বিএসইসি সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরো বলেছেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারদর বাড়বে-কমবে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু শক্তিশালী একটি পুঁজিবাজার গড়তে হলে ভালো মানের কোম্পানি বেশি থাকতে হবে। গত কয়েক বছরে যেসব কোম্পানি বাজারে এসেছে তার বেশির ভাগ দুর্বল আর্থিক ভিত্তির প্রতিষ্ঠান। ভালো মানের কোম্পানি আনতে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ। তাদের উচিত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। বিএসইসির এই সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, বাজারে আস্থা ফেরাতে ট্রেডিংয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ২০১০ সালের পর স্টক এক্সঞ্জের মালিকানা পৃথককরণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এটা কিছুই হয়নি।

স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ট্রেডার মালিকানা আলাদা থাকবে। কিন্তু এক ধরনের জগাখিচুড়ি করে ট্রেডাররা মালিকানা ধরে রেখেছেন। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ট্রেড করছেন। সাধারণ বিনিয়োগকারী যারা তাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা পুরোপুরি জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। মানসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে জোর দিতে হবে। যারা মেনুপুলেশন করে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই মেনুপুলেট ব্যক্তিরা বাজারে সক্রিয় থাকলে কখনই শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে না। স্থিতিশীল হবে না দেশের পুুঁজিবাজার।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ বলেন, এই নিয়মের ফলে যাদের আগে ৩০ পারসেন্ট শেয়ার ছিল, তাদের শেয়ারের পরিমান কমে যাবে। বিএসইসি যদি নিজেদের আইন নিজেরাই সঠিকভাবে না মানে, তাহলেতো তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। তিনি জানান, অনেক কোম্পানীর পরিচালকরাই ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করছেন, এরফলে যে ট্যাক্স দিতে হয় তা তারা দেয়নি।

স্টক এক্সচেঞ্জের যে সিআরও আছে তার দেখা দরকার ছিল কি পরিমান শেয়ার বিক্রি হয়েছে এবং কারা আইন ভঙ্গ করে শেয়ার বিক্রি করেছে। যারা আইন ভঙ্গ করে শেয়ার বিক্রি করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের বিরুদ্ধে বিএসইসি’তে জানাবে। এমন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আরো আগে ব্যবস্থা নিলে বাজারে এমন দরপতন হতো না বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ।

তিনি বলেন, বেআইনিভাবে ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করা অপরাধ। এর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। তা না হলে শেয়ার বাজারে কোন শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। এরপরেও কোনো উদ্যোক্তা-পরিচালক আইন ভঙ্গ করলে তাদের কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নন কমপ্লায়েন্স ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হবে।