দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ইউনাইটেড এয়ারের বাইব্যাকের গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লুটছে কারা এ প্রশ্ন এখন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। চক্রটি কৌশলে ‘বাইব্যাক’ আইন হচ্ছে এমন তথ্য ছড়িয়ে শেয়ার দাম প্রভাবিত করা হচ্ছে। আর অজ্ঞতার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যাচাই-বাছাই ছাড়াই গুজবের ফাঁদে পা দিচ্ছে হওয়ার উপক্রম হচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার একের পর এক গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যার ফায়দা লুটছে কারসাজিচক্র। হঠাৎ হঠাৎ একটি গোষ্ঠী বাজারে ছড়ায় আর বিনিয়োগকারীরা সে বিষয়ে প্রভাবিত হয়। সঠিক তথ্য না জেনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।’

মতিঝিলে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ঘুরে দেখা গেছে, ছোট ও কম দামের শেয়ার কেনার আগ্রহের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিনিয়োগকারীরা জানায়, তারা শুনেছে ইস্যু মূল্যের নিচে থাকা কম্পানির শেয়ার কিনতে বাইব্যাক আইন করা হচ্ছে। এই আইন হলে ওই কম্পানি ইস্যু মূল্যে ওই শেয়ার কিনতে বাধ্য হবে। কাজেই এখন যেসব কম্পানির শেয়ার ইস্যু মূল্যের অনেক নিচে নেমেছে, তা কিনলে তারা লাভবান হবে এমনটা ভাবছে।

অস্থিত্বহীন দেওলিয়া হবার পথে থাকা এভিয়েশন কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ার লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। শেয়ারটির মূল্যকে কৃত্রিমভাবে প্রভাবিত করতে গত কয়েকদিন ধরে এক বা একাধিক ‘ক্রেতা’ বড় অংকের শেয়ার কেনার আদেশ দিচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ট্রেডিং সিস্টেমে। আজ রোববার ও গত বৃহস্পতিবার প্রতিদিন এই কোম্পানির একই দরে দেড় কোটির বেশি শেয়ার কেনার আদেশ দেওয়া হয়।

এদিকে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ডিএসইর একাধিক চিঠির জবাবে জানিয়েছে, তাদের কাছে অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই। তার পরও গত দুই কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য ১০ শতাংশ করে বেড়েছে। আর গত ৬ কার্যদিবসে দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।

অন্যদিকে আজই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এক চিঠিতে ডিএসইকে ইউনাইটেড এয়ারসহ ৪টি কোম্পানি পরিদর্শন ও তদন্ত করার অনুমতি দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগে থেকেই এ তথ্য জানতে পেরে বড় ধরনের হোল্ডিংস আছে এমন কোনো বিনিয়োগকারী কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম ও চাহিদা বাড়িয়ে তার বা তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যাওয়ার জন্য এই কারসাজি করছেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন শুরুর দাম ছিল ২ টাকা ২০ পয়সা। এর থেকে ২০ পয়সা কমিয়ে ২ টাকায় দরে প্রথমে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩১৫ শেয়ার ক্রয়ের আবেদন পড়ে। তবে কেউ এই দামে শেয়ার বিক্রি করতে রাজি হননি।

এরপর ২ টাকা ১০ পয়সা দামে ৩ লাখ ১৩ হাজার শেয়ার ক্রয়ের আবেদন আসে। এ দামেও কেউ শেয়ার বিক্রি করতে রাজি হননি। তারপর ২ টাকা ২০ পয়সা দরে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার ৪৯৪টি শেয়ার ক্রয়ের আবেদন আসে। তবে এ দামেও কেউ শেয়ার বিক্রি করতে চায়নি। ফলে মাত্র ৩টি ক্রয় আবেদনেই শেয়ার দাম বেড়ে সার্কিট বেকারে (দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা) চলে আসে। এরপরও কোম্পানিটির শেয়ারের বিক্রেতা শূন্যই থেকে গেছে।

ডিএসসি তথ্য অনুযায়ী, এই কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মাত্র ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৭০ দশমিক ২৬ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং বিদেশিদের কাছে ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার আছে।

হঠাৎ হঠাৎ শেয়ারের দাম এমন বাড়লেও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যবসায়িক কার্যক্রম কয়েক বছর ধরেই বন্ধ রয়েছে। এমনকি কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার থেকে কয়েক’শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

১০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ২০১০ সালে শেয়ারবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এরপর ২০১১ সালে রাইট শেয়ার ও ২০১০ সালে ৫ শতাংশ, ২০১১ সালে ১০ শতাংশ, ২০১২ সালে ১৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ১২ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ ও ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে কোম্পানিটি মূলধন বাড়ায়। বর্তমানে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৮২৮ কোটি টাকায়।

২০১৫ সালের পর কোম্পানিটি আর কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কাছে ২০১৫ সালের পর কোম্পানির কোনো তথ্যও নেই। ডিএসইর ওয়েবসাইটেও ২০১৫ সালের পর তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি। সর্বশেষ সাধারণ সভা হয় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, কোম্পানিটির পরিচালকরা ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে তাদের হাতে থাকা কোম্পানির ৩৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০১২ সালে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ দশমিক ০২ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি থেকে প্রায় ৮২৪ কোটি ২২ লাখ টাকা তুলে নেন।

২০১০ সালের তালিকাভুক্তির পরের বছর ২০১১ সালে কোম্পানির পরিচালকদের হাতে থাকা ৫০ শতাংশ শেয়ারের ৩৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেন। ওই বছরে শেয়ারের গড় দাম ছিল ৪৬ দশমিক ৪০ পয়সা। সেই হিসাবে পরিচালকরা প্রায় ৭৬৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা পুঁজিবাজার থেকে তুলে নেন।

পরের বছর ২০১২ সালে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ শেয়ার ২৩ দশমিক ৭০ টাকা গড় দামে বিক্রি করে তারা উঠিয়ে নেন প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এরপর ২০১৩ সালে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ শেয়ার ২০ দশমিক ৩১ টাকা গড় দামে ৪৫ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে ৯ দশমিক ৯২ টাকা গড় দামে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা তুলে নেন।

আর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শেয়ার গড় ৬ টাকা দামে বিক্রি করেন। সব মিলে তালিকাভুক্তির পর মাত্র পাঁচ বছরে ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০টি শেয়ার বিক্রি করেন উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে বাইব্যাক আইন হবে নাকি সংশোধনীর মাধ্যমে বাইব্যাক নীতিমালা যুক্ত হবে, সেটা ঠিক হয়নি। এখন বাইব্যাক বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। হঠাৎ হঠাৎ একটি গোষ্ঠী বাজারে ছড়ায় আর বিনিয়োগকারীরা সে বিষয়ে প্রভাবিত হয়। সঠিক তথ্য না জেনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে বাজারে গুজব ছড়ানো হয়েছে বাইব্যাক আইন হচ্ছে। আসলে এই তথ্যের কোনো সত্যতা আছে কি না জানি না; কিন্তু বিনিয়োগকারীরা কম দামের ছোট ছোট কম্পানির শেয়ার কিনছে। তারা মনে করছে, বাইব্যাক আইন হলে ইস্যু মূল্যে কম্পানি শেয়ার কিনবে।’ এটা স্রেফ গুজব।