মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত টাকা দিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হলেও ঋণ আরো বেড়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে নতুন ঋণের জন্য আবেদন করা হলেও খেলাপি হওয়ায় ঋণ মেলেনি। যে কারণে আবারো নতুন করে রাইট শেয়ারের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করতে যাচ্ছে আরএসআরএম স্টিল (রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস) কোম্পানি লিমিটেড।

আরএসআরএম স্টিল ঋণের কিস্তি পরিশোধে এখন দিশেহারা। তারল্য সংকট এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে একে একে কোম্পানিটির সব ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় রাইট শেয়ারের মাধ্যমে আবারও পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে আরএসআরএম স্টিল।

কাগজে-কলমে ব্যবসা স¤প্রসারণের কথা বলা হলেও উত্তোলিত অর্থে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবে বলে বাজারে জোর প্রচারণা রয়েছে। ২০১৪ সালে ৩০ টাকা প্রিমিয়ামসহ আড়াই কোটি শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে আরএসআরএম গ্রুপের কোম্পানি আরএসআরএম স্টিল। এবারে তিনটি শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট ছাড়তে চায়। এ জন্য কোম্পানিটি ১০ টাকা ফেসভ্যালুর সঙ্গে ১৫ টাকা প্রিমিয়ামের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৪ সালে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা তুলেছে আরএসআরএম স্টিল। প্রকৌশল খাতের কোম্পানিটি মূলধন জোগানো ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য ওই অর্থ নিয়েছে। কিন্তু তিন বছর পরও আরএসআরএমের ঋণের বোঝা কমেনি। কাটেনি মূলধন সংকটও।

এদিকে ঋণের তথ্য গোপন, অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয় ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরএসআরএম স্টিলের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
আরএসআরএমের কোম্পানি সচিব জাফর আলম বলেন, তালিকাভুক্তির পর কোম্পানির অবস্থার উন্নতি হয়েছে, আয়-মুনাফা বেড়েছে। মূলত ব্যবসা স¤প্রসারণের জন্য পুঁজিবাজার থেকে রাইটের মাধ্যমে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিশেষ সাধারণ সভায় বিনিয়োগকারীদের অনুমোদনের পরই বিএসইসির কাছে অনুমতি চাওয়া হবে। রাইটের অনুমোদন নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর নির্ভর করছে। যথাসময়ে বিষয়টি জানানো হবে। আইপিও’র অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহারের অভিযোগ সত্য নয়। টাকা কীভাবে ব্যয় হয়েছে, কোথায় কত ঋণ আছে সব তথ্য বার্ষিক প্রতিবেদনে আছে, এর বাইরে বলার কিছু নেই।

আইপিও প্রসপেক্টাসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আরএসআরএম স্টিলের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে মোট বকেয়া ছিল ১৪৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে আইপিও’র অর্থে ৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করার পর কোম্পানিটির মোট ঋণ অর্ধেক কমার কথা।

কিন্তু আইপিও’র অর্থ ‘ভিন্ন খাতে’ ব্যয় ও নতুন করে ঋণ নেওয়ার কারণে এর পরিমাণ কমেনি, বরং তিন বছরে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে আইপিও ও ব্যাংক ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও বিদেশে পাচারের কারণেই কোম্পানিটি এ সমস্যায় পড়েছে।

নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে আরএসআরএম স্টিলের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের তিন ধরনের ঋণের বিপরীতে প্রায় ১৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে।

পরিচালকের ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা ও বিদ্যমান জমি-সম্পদ-কাঁচামাল বন্ধক দিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ওই ঋণ নিয়েছিল আরএসআরএম স্টিল। সেইসঙ্গে লিজ হিসেবে বেসরকারি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের কাছে প্রায় তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা ও আইআইডিএফসির কাছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। ২০১৬ সালের জুনশেষে আরএসআরএম স্টিলের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ প্রায় ১৪২ কোটি ২১ টাকা বলে দাবি করছে কোম্পানিটি, যদিও এ হিসাবের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর তথ্যের মিল নেই।

সোনালী ব্যাংকের হিসেবে, আরএসআরএম স্টিলের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১৫৫ কোটি টাকা। অথচ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এ বকেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৭ কোটি টাকা কম দেখিয়েছে আরএসআরএম স্টিল। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণের তথ্যও গোপন করেছে কোম্পানিটি। অর্থাৎ প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত মিলিয়ে আরএসআরএম স্টিলের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তবে কোম্পানির লিজ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ বিষয়ে ডিএসইকে স্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি কোম্পানিটি।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যানুযায়ী, আরএসআরএম স্টিলের ৫০০ কোটি টাকাসহ আরএসআরএম গ্রুপের দুটি কোম্পানি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গ্রুপের অন্য কোম্পানি মডার্ন স্টিলের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ৩০৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা ও জনতা ব্যাংকের ৪০৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে গ্রুপটির বেশিরভাগ ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

খেলাপি ঋণ আদায়ে মডার্ন স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে সম্প্রতি মামলাও করেছে জনতা ব্যাংক। ঋণ পুনর্গঠনের পর সোনালী ব্যাংকের কাছে কোম্পানিটির পাওনা দাঁড়িয়েছে আরও ২৭৫ কোটি টাকা। খেলাপির কারণে নতুন কোনো ঋণ না পাওয়ায় আরএসআরএম গ্রুপ তারল্য সংকটে বিপাকে পড়েছে।

আর সংকট কাটিয়ে উঠতে আরএসআরএম স্টিলের রাইটের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইপিও’র অর্থে ‘ঋণ পরিশোধের’ পর এবার ‘ব্যবসা স¤প্রসারণ’ করার কথা বলছে আরএসআরএম স্টিল। এদিকে রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড আগের প্রস্তাবিত রাইট শেয়ারের মূল্য কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, কোম্পানিটির রাইট শেয়ারের মূল্য ২০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। যাতে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সাথে ৫ টাকা প্রিমিয়াম নেয়া হবে। এর আগে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সাথে ১০ টাকা প্রিমিয়ামসহ রাইট শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ টাকা। এর আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কোম্পানিটি ২আর:৩ অনুপাতে অর্থাৎ ৩টি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট শেয়ার ইস্যুর ঘোষণা দিয়েছে।

কোম্পানিটির রাইট শেয়ারের মূল্য পুনঃনির্ধারণে শেয়ারহোল্ডার এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন সাপেক্ষে চূড়ান্ত হবে। শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতির জন্য কোম্পানিটির বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আগামি ৯ অক্টোবর, বেলা ১১টায়, শহীদ গল্ফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, পতেঙ্গা, চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে। এ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ৩০ টাকা প্রিমিয়ামসহ আড়াই কোটি শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে আরএসআরএম গ্রুপের কোম্পানি আরএসআরএম স্টিল। পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত অর্থে ঋণ পরিশোধের ঘোষণা দিয়ে বিতর্কের মধ্যে পড়ে ‘পরিবার নিয়ন্ত্রিত’ কোম্পানিটি।

বর্তমানে আরএসআরএম স্টিলের মোট প্রায় ১০ কোটি ১১ লাখ ৮৯ হাজার ৮৮টি শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ৪৭ দশমিক ০৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।