গোলাম মাহমুদ, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  বীমা খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসছে না। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকের অর্থ ব্যয় করছে জনতা ইন্সুরেন্স। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজার হাজার বীমা গ্রহীতা ও বিনিয়োগকারীরা। তবে আইডিআরএ বলছে, গ্রাহকের পলিসির টাকা বেপরোয়া ব্যয়সহ বীমা কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম রোধে কঠোর অবস্থানে এখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেলেপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথোারিটি (আইডিআরএ)।

এদিকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইআরডিএ) নির্ধারিত ব্যয়সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করেও ব্যবসা সফল হতে পারেনি জনতা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। তবে বিনিয়োগকারীদের রোষের কবল থেকে বাঁচতে আর্থিক প্রতিবেদনে নেয়া হয়েছে কারচুপির আশ্রয়।

এরপরও বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) বিব্রত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ের আগেই এজিএমে প্রবেশ নিবন্ধন সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করেছে কোম্পানিটি। জনতা ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

গত ৩০ জুলাই রাজধানীর খিলক্ষেতে অবস্থিত ‘হোটেল লা মেরিডিয়ান’ এর মিলনায়তনে এই কোম্পানির এজিএম অনুষ্ঠিত হয়। সকাল এগারোটায় এজিএম সময় নির্ধারিত হলেও দূর-দূরান্তের বিনিয়োগকারীরা বেলা বারোটার সময়ও এজিএম হলে উপস্থিত হতে থাকে। অন্যদিকে এজিএমে উপস্থিতির নিবন্ধন সময় বেলা এগারোটার পর পরই বন্ধ করে দেয়া হয়।

নির্ধারিত সময়ের ২/৩ মিনিট পরে উপস্থিত বিনিয়োগকারীদেরও নিবন্ধনের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। তবে জনতা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য আতঙ্ক হিসাবে কাজ করছে এজিএম পার্টি। যেসব কোম্পানি ক্রমাগত নিচের দিকে ও দুর্নীতি পরায়ন সেসব কোম্পানির এজিএমে এই পার্টির উৎপাত বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে অন্যসব কোম্পানিও এর বাহিরে থাকে না।

প্রত্যেকটি কোম্পানি তাদের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে সামর্থ্য অনুযায়ি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ইতিমধ্যে ২০১৮ সালের জন্য কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লক্ষে লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। যা এজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনের মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে।

কিন্তু অনেক সময় একটি কোম্পানি ভালো আয় করা সত্তে¡ও পরিচালকরা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে তা থেকে বঞ্চিত করে বিনিয়োগকারীদেরকে। আবার তাদের দূর্ণীতির কারণে বিলীনও হয়ে যায় অনেক কোম্পানি। এদিকে বর্তমানে এমন পরিস্থিতি চলে এসেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ না চাইলেও এজিএম পার্টি নিজেরাই চাঁদা নির্ধারণ করে দায়িত্ব পালন করে।

যার পরিমাণ সাধারণত ৫-১০ লাখ টাকা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নিতে পারে না তাদের দূর্বলতা বা অনৈতিকতা প্রকাশ হওয়ার ভয়ে। এছাড়া এজিএমে পার্টির হাত থেকে মানসম্মান রক্ষার জন্যও অনেকে আবার বাধ্য হয় তাদের চাঁদা দিতে।

বিভিন্ন কারনে একটি কোম্পানির এজিএমে এই পার্টির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কোম্পানি অনেক সময় নিজেরা তাদের নিয়োগ দেয়। আবার অনেক কোম্পানিতে পার্টিগুলো জোরপূর্বক প্রবেশ করে। যেসকল পরিচালকরা নিয়োগ দেয়, তাদের অধিকাংশ পরিচালক দূর্ণীতির সাথে জড়িত থাকে। আর এই অপকর্ম আড়াল করতেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে কোন ক্ষেত্রেই তাদের প্রভাব লক্ষ করা যায় না। এসব কোম্পানির কর্তৃপক্ষের সততার কারনেই এজিএম পার্টি কিছু করতে পারে না বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা।

কোম্পানি আইন অনুযায়ি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোকে প্রত্যেক বছর এজিএম করতে হয়। যাতে করে শেয়ারহোল্ডাররা তাদের মতামত তুলে ধরতে পারেন। যেখানে তারা কোম্পানির আলোচ্য বিষয়সমুহ ইতিবাচক মনে হলে পাশ, অন্যথায় না করতে পারেন। কিন্তু ঘটে যাওয়া কোম্পানিগুলোর এজিএমে গিয়ে দেখা যায় বিনিয়োগকারীরা কোনো ধরনের মতামত দেওয়ার মতো সুযোগ পান না।

কোম্পানির সমস্ত বিষয়ে মতামত দেন কোম্পানিরই ভাড়া করা কিছু লোক। যাদের কে এজিএম পার্টি হিসাবে ডাকা হয়। বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় প্রত্যেকটি কোম্পানির এজিএমে একই লোকের উপস্থিতি। সাধারন শেয়ারহোল্ডাররা তাদের চেনেন না। কিন্তু তারাই দেখা যায় সব বিষয়ে মতামত পেষণ করেন। যার ফলে সাধারন শেয়ারহোল্ডাররা কোনো কিছুই করতে পারে না।

আর কেউ যদি কিছু বলতে চায় তাহলে তাকে মার খেতে হয়। শেয়ারহোল্ডাররা অভিযোগ করে বলেন, এভাবে আর কতোদিন অধিকার বঞ্চিত থাকব। তাই আবার এজিএম পার্টির খপ্পরে শেয়ারহোল্ডাররা যেন অধিকার বঞ্চিত না হয় সেদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজর দেওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, বিশৃঙ্খলা এড়াতে এজিএমে কোন ধরনের গিফট বা আপ্যায়নের ব্যবস্থা না করার জন্য এরইমধ্যে দুই দফায় নির্দেশনা জারি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে এজিএম পার্টি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘ দিনের দাবি থাকলেও সে বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

একাধিক বিনিয়োগকারী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বীমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত ব্যয় সম্পর্কে ইতিপূর্বে অনেকবার সতর্ক করেছে। এরপরও প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত ব্যয় কমাতে পারেনি। বরং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আইডিআরএ’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি তাদের নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা বেশি ব্যয় করেছে। তবে এই অতিরিক্ত ব্যয় করেও তারা ব্যবসায়িকভাবে সে তুলনায় লাভবান হতে পারেনি। আবার আর্থিক প্রতিবেদনও কারচুপি করেছে বলে বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন।

আব্দুল ওহাব নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, বার্ষিক প্রতিবেদনের ৯৪ পৃষ্ঠা ১১.০৮ নং নোট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধযোগ্য অফিস ভাড়া দেখিয়েছে আড়াই লাখ টাকারও বেশি, যা আগের বছর ছিল মাত্র ৭০ হাজার টাকা। আমার জানামতে, অফিসটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব। তবে কি কারণে হঠাৎ অফিস ভাড়া প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেল?

অন্যদিকে বিজ্ঞাপন ও ডোনেশন বাবদ মোট খরচ দেখিয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আগের বছর এই খাতে খরচ ছিল ৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। হঠাৎ কি কারণে বিজ্ঞাপন ও ডোনেশন এমন বেড়ে গেল তা বলা হয়নি প্রতিবেদনে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞাপন ও ডোনেশন কোথায় দেয়া হয়েছে তারও কোনো উল্লেখ নেই বার্ষিক প্রতিবেদনে। এ নিয়ে কথা বলতে এজিএমে আমাদের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।

আতাউল গনি নামে অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন, প্রতিষ্ঠানটি গত বছরে এফডিআর এবং ট্রেজারি বন্ড থেকে প্রায় ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা আয় করলেও এ বছর করেছে মাত্র ৯৭ লাখ টাকা। এ বিষয়ে কোম্পানির লোকেরা বলেছে, সরকার এফডিআর এর সুদ হার কমিয়ে দিয়েছে তাই নাকি এমন অবস্থা। কিন্তু আমি জানতে চাই, টাকার সুদের হারতো হঠাৎ করে কমেনি। কেন পরিচালকরা অন্য অলাভজনক খাতে বিনিয়োগ করেনি অথচ এই বছর তারা ব্যবসায়িক মিটিংও বেশি করেছে আর পরিচালন ফি আগের বছরের দ্বিগুণ নিয়েছে। পরিচালন ফি আগের বছর ছিলো ৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা, এ বছর এই ফি হয়েছে ১০ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এতো ফি নিয়ে এত মিটিং করে কি লাভ হলো কোম্পানিটির।

আব্দুর রাজ্জাক নামে অপর এক বিনিয়োগকারী জানান, প্রতিষ্ঠানটি শুধু গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করছে না, সেইসাথে সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারের সাথেও প্রতারণা করছে। চলতি বছরের এই সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের নিকট সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পুনঃবীমা বাবদ ৩৩ কোটি ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৬ টাকা পাওনা রয়েছে।

এ নিয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও প্রতিষ্ঠানটি আজ/কাল দেবো বলেও পরিশোধ করছে না। উপায় না পেয়ে অবশেষে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শরণাপন্ন হয় সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে সর্বশেষ জানামতে আইডিআরএও তেমন ভূমিকা নিতে পারছে না এই পাওনা পরিশোধে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বার্ষিক সাধারণ সভায় যেন এ নিয়ে কোনো বিব্রত অবস্থার সম্মুখীন হতে না হয়, তাই কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট বিপুলসংখ্যক বহিরাগত লোক দিয়ে এজিএম স্থল পূর্ণ করে রাখছে।

বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়ম নিয়ে কার কাছে বিচার চাইবো? যেখানে তারা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই তোয়াক্কা করছে না। আমাদের অবস্থা দেখার কেউ নেই, শোনারও কেউ নেই। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে গ্রাহকের বীমা টাকা আদায়ে গড়িমসি করায় কয়েকবার জনতা ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান ও এর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে সতকর্তা ও জরিমানা করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিএআর)।