দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১০ সালের পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও বার বার দরপতনের বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। মাঝে মধ্যে বাজারে কয়েকবার আশার আলো উকি মারলেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান কমার বদলে বাড়ছে। মুলত গুজব, আস্থার সঙ্কট, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকিং খাতের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ডে- ট্রেডারের মতো আচরণ, কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম, নির্ধারণী মহলের দায়সারা মনোভাব বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, ২০১০ সালের ধসেই বিনিয়োগকারীরা তাদের কষ্টার্জিত পুঁজি হারিয়েছে। পরবর্তীতে নীতি নির্ধারণী মহলের আশার বানীতে অসংখ্য বিনিয়োগকারী হারানো পুঁজি ফিরে পাওয়ার আশায় নতুন করে বিনিয়োগ করলে লোকসানের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

তবে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুক‚ল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিন্মমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।

বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

তবে পুঁজিবাজারের হঠাৎ এ দরপতকে সরলভাবে নিতে পারছেন না দক্ষ বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি, পুঁজিবাজারের এ দরপতনের পেছনে আবারও কোনো কারসাজি চক্র সক্রিয়, বিএনপি জামায়াতপন্থী ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মালিকরা পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে চায় তা দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়া সাত ইস্যুতে চলমান দরপতনে অস্বস্তিতে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। চলমান দরপতনে বাজার মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে থেমে থেমে চলা দরপতনে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাড়ে ২৫ লাখ বিনিয়োগাকারীর পুঁজি অর্থাৎ বাজার মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার ২৭০ কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা। ফলে বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি দুই স্টক এক্সচেঞ্জ, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও সরকার অস্বস্তিতে রয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৯ সালে প্রথম ৬ মাসে মুদ্রানীতির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে পুঁজিবাজারে দরপতন শুরু হয়। এরপর অনৈতিক প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক এবং মন্দ কোম্পানির আইপিওর অনুমোদনকে কেন্দ্র করে জুন মাস পর্যন্ত পুঁজিবাজারে দরপতন চলে।

তারপর নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় পুঁজিবাজারে টালমাটাল অবস্থা, আর তার সঙ্গে যোগ হয় অর্থমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্য। এরপর বাজেট ঘোষণা হয়, কিন্তু প্রত্যাশা অনুসারে বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা না থাকায় চলতেই থাকে দরপতন। এগুলো কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে বকেয়া পাওনা আদায়ে শুরু হয় বিটিআরসি ও গ্রামীণফোনের প্রকাশ্য দ্ব›দ্ব। তাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে। এছাড়াও সবশেষ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত ও রিজার্ভের অর্থ সরকার নিয়ে নেবে এমন ঘোষণায় দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সুশানের অভাব। এ কারণে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে না। বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোও তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। অন্যদিকে একটি গ্রæপের কাছে বাজার জিম্মি হয়ে গেছে। ফলে প্রকৃত বিনিয়োগকারী বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ স্থবির রয়েছে। তাতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সুশাসনের অভাবকেই বড় কারণ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি-উল মারুফ মতিন। তিনি বলেন, সমস্যা হচ্ছে: পুঁজিবাজার বিষয়ে ভালো ধারণা রাখেন এমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির অভাব বাজারে সর্বত্র। ফলে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনেক পদক্ষেপ সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিয়েছে, অনেক আইনের সংস্কার হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ কিছুই হয়নি। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের এ বাজারের প্রতি আস্থা নেই।

ইবিএল সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, শেয়ারের দাম কম, কিনলেই লাভ হবে এমন প্রত্যাশায় গত ৮ বছর পর নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন যারা তারাও লস করছেন। বাজারে যে কারা মুনাফা করছে বলাটা মুশকিল। কেউ বলতে পারছেন না বাজার পরিস্তিতি কোন দিকে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, এখানে ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ সব স্টেকহোল্ডার কেবল নিজেদের স্বার্থটাই দেখে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে সুশাসন নেই। মালিকরা বেনামে শেয়ার ব্যবসা করছে। তারা ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদন দিচ্ছে। অনেক অডিট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় কেউ আর্থিক প্রতিবেদনে বিশ্বাস রাখতে পারছে না। অথচ বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটাই প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ অবস্থায় কোনো বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করবে না। আবু আহমেদ বলেন, আসলে স্টক এক্সচেঞ্জ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি দায়িত্বশীল হতো তাহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, যে বাজারে ভালো পণ্য বিক্রি হয় না সেই বাজারে ভালো ক্রেতাও থাকে না। পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও একই কথা। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ভালো কোম্পানির শেয়ার আনার কথা বলছি, কিন্তু ভালো কোম্পানি আসছে না। যেগুলো আসছে সেগুলো কি মূলধন সংগ্রহের জন্য আসছে নাকি সেগুলোর মালিকরা শেয়ার ব্যবসা করে টাকা হাতিয়ে নিতে আসছেন এ প্রশ্ন এখন অনেকের।