দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানী। এছাড়া ছাত্রলীগের ওই কমিটির বাকি নেতাদের অতীতের সকল কর্মকাণ্ডের (প্রিভিয়াস রেকর্ড) চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র ও হেভিওয়েট নেতাদের পরামর্শ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, ছাত্রজীবনে তাদের প্রিভিয়াস রেকর্ডও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রত্যেক নেতার আবাসস্থল, কর্মস্থল এবং গ্রামের বাড়িতে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। তাদের পূর্বেকার স্বজনদের জীবনধারা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে বলেও জানায় গোয়েন্দা সূত্র।

ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠার পর তাদেরসহ অন্য শীর্ষ নেতাদের নজরদারিতে রেখেছে আওয়ামী লীগের অলিখিত একটি শক্তিশালী টিম।

ওই টিমের সদস্যরা সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে এবং পরবর্তী কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচন করতে দলকে পরামর্শ দেবে। তা ছাড়া ছাত্রলীগ নিয়ে পূর্বেকার জমাকৃত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করছেন দলের শীর্ষ নেতারা। বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটিতে কাদের আনা যায় সে বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করছেন তারা।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার ওপর ক্ষুব্ধ হওয়ায় সংগঠনটির বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে দুই নেতাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে আপাতত সংগঠন পরিচালনা করা হতে পারে। এরপর নতুন সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। এমন আভাস পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ছাড়াও স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। আগামীকাল শনিবার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে এসব অভিযোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ইস্যুটিই নিয়ে প্রথম পর্যায়ে সমাধান করা হবে বলে জানান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ভেতরে রেখে সহনীয় পর্যায়ে থাকতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতারা। ছাত্রলীগের মাধ্যমে যেন দল ও শেখ হাসিনার সুনাম ক্ষুণ্ন না হয়- এ ব্যাপারে তৃণমূল নেতাদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।

২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অভিভাবক, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিতে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় এক বছর নানা নাটকীয়তার পর গত ১৩ মে ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রলীগ। এরপর শুরু হয় নতুন সংকট।

কমিটিতে বিবাহিত, অছাত্র, স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তান, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের স্থান দেয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্কের মুখে পড়েন শীর্ষ নেতৃত্ব। একাধিক স্থানে সংঘর্ষও হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ৯৯ জনই বিতর্কিত-অযোগ্য দেখিয়ে তালিকা প্রকাশ করে সংগঠনেরই কিছু নেতাকর্মী।

তাদের অভিযোগ, অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে ত্যাগীদের অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রলীগের কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের প্রায় পাঁচ মাস পার হলেও শোভন-রাব্বানী ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ ও বিতর্কের সমাধান করতে পারেনি।

ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীর বিরুদ্ধে সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা ও অদক্ষতার প্রমাণসহ রিপোর্ট শেখ হাসিনার কাছে জমা দিয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে বিরোধী মতাদর্শীদের অর্থের বিনিময়ে সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঘটানো, স্বেচ্ছাচারিতা, দুপুর পর্যন্ত ঘুমানো, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের অগ্রাহ্য করা, মাদক সেবন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবিরসহ ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করা উল্লেখযোগ্য।

মূলত এসব অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় সম্প্রতি ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার ওপর ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে অযোগ্য ও স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তানদের ছাত্রলীগের পদ দেয়ায় বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন তিনি। তা ছাড়া প্রায় দেড় বছর সময়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে না পারার কারণে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

শোভন ও রাব্বানীর গণভবনে প্রবেশ পাস এরইমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার গণভবনে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। এর আগে গত শনিবার আওয়ামী লীগের যৌথসভায় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে বর্তমান কমিটি ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তার ওই সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ নিয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ছাত্রলীগ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না বলে জানান। এর আগে গত বুধবার তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রী দেখছেন।

তবে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের চার জনকে ছাত্রলীগের বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন নেত্রী। বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে এখনই নতুন কমিটি গঠনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি বলে তিনি জানান।