দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন মন্ত্রী, এমপিসহ আওয়ামী লীগের ৬৭ নেতা-কর্মী। তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান মন্ত্রিসভার দুইজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী। তাদের বিরুদ্ধে ভূমি দখল ও টেন্ডারবাজিসহ সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঠিকাদারকে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে।

অন্যজনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে একজন ঢাকার, একজন ভোলার এবং আরেকজন কুমিল্লার। তাদের মধ্যে ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভারও সদস্য রয়েছেন। একজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানার ওসি ও এসআই পর্যায়ের পুলিশের কর্মকর্তাদের বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থা ও দলের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে কেউ যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য এখনই তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। এমনকি বিমানবন্দর ও সীমান্তেও সর্তকতা জারি করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যে শুদ্ধি অভিযান চলমান রয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগের ৬৭ নেতা টার্গেটে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অপকর্মের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনের সূত্র মতে, সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অন্তত ৩ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ২৭ জন বর্তমান এমপি, ৩০ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও ৭ জন রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা-কর্মী।

৬৭ জনের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তার মধ্যে অঙ্গ সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোকে রাখা হয় নি। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের আরও ৯৩ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলা চুলচেরা বিশ্লেষণের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সে জন্য তাদেরও নজরদারি করে রাখা হয়েছে। তবে সূত্র বলছে, তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নেতা-কর্মী অভিযানের জালে আটকা পড়বেন।

আওয়ামী লীগের ২৭ জন এমপির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা, সন্ত্রাসে উস্কানি দেয়া, টেন্ডারবাজদের সহায়তা করা এবং পেশিশক্তির মাধ্যমে জমি এবং সম্পদ দখলের তথ্য-প্রমাণাদি গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে। অন্য নেতারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী, যারা নিজেদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস এবং স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা।

প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুর্নির্দিষ্ট অভিযোগের তালিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন সাপেক্ষে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা ও কর্মস্থলের আগের রেকর্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র দাবি করেছেন। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরলেই অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শুদ্ধি অভিযানের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, প্রথম পর্যায়ে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগই আক্রান্ত হয়েছে। আরও হবে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ দিয়ে শুরু হলেও এই অভিযান শুধু ছাত্রলীগ বা যুবলীগের ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। একটি সুর্নির্দিষ্ট তালিকার মাধ্যমে অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা যেখানেই পাওয়া যাচ্ছে বা যাবে, সেখানেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বা হবে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৫ শতাধিক ব্যক্তির নানা অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করা হয়েছিল। তার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে আওয়ামী লীগের ৬৭ জন এবং অঙ্গ-সংগঠনের ৯৩ জনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে, শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যারা মদদ দিয়েছেন, যারা তাদের এসব অনিয়ম, অপকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যারা সহযোগিতা করেছেন বা জড়িত ছিলেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এই অভিযান কতদিন চলবে সে বিষয়েও এখন পর্যন্ত কোনও সুর্নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় নি।

তবে গোয়েন্দা কর্মকতারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর এই শুদ্ধি অভিযানের একটি সুর্নির্দিষ্ট পরিকল্পনা পাওয়া যাবে। আগামী বিজয় দিবসের আগেই এই শুদ্ধি অভিযানের ইতিবাচক ফলাফল জনগণ পেতে শুরু করবেন। এরই মধ্যে দেশের মানুষের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান নিয়ে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তারা আশাবাদী শুদ্ধি অভিযানের ফলে কিছুটা হলেও উপকার হবে দেশের মানুষেরই।

দলের একাধিক সূত্র দাবি করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন তার ব্যাপারে কোনও ছাড় নয়। তাই তিনি মুজিববর্ষের আগেই একটি নতুন এবং ক্লীন ইমেজের আওয়ামী লীগ যেমন দাঁড় করাতে চান, তেমনি বাংলাদেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের বার্তাটি দেশে এবং বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। সেই লক্ষ্যেই কারও প্রতি কোনও রকম সহানুভূতি বা অনুকম্পা না দেখানোর কঠোর নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।