দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ফলে তারল্য সংকট রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি আইএফআইসি ব্যাংক। ধারাবাহিকভাবে কমছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। আমানত ও ঋণের সুদহারেও নেই শৃঙ্খলা। ফলে নানামুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। যার প্রভাব পড়েছে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের (জানুয়ারি-জুন) পরিচালন মুনাফায়।

এদিকে আইএফআইসি ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের পকেট কাটার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ‘বিশেষ অশুভ প্রক্রিয়ায়’ রাইট শেয়ারের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের সব সম্ভাবনা তৈরি করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। টানা ১৬ বছর ধরে বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে যাচ্ছে আইএফআইসি। এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ার থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড গেইন হয়নি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট শেয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩৫টি। আবার রাইট শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ব্যাংকটি। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ব্যাংকটির মোট শেয়ার দাঁড়াবে ১৭০ কোটিরও উপরে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব সময় বোনাস লভ্যাংশ দেয়া মানে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের ঠকানো। পাশাপাশি ডিভিডেন্ড গেইন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এদিকে বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঠেকেছে ১ হাজার ৪৬০ হাজার কোটি টাকা। ঝুঁকি এড়াতে সরকারি মালিকানা শেয়ারের বিপরীতে বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে ৪৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা চেয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কারণে ব্যাংকগুলোকে কয়েক বছর ধরে এমন সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এরপরও ব্যাংকগুলো নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারছে না। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো হিসাবের মূলনীতিকে পাশ কাটাচ্ছে।

এদিকে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর লক্ষ্যে আবারো রাইট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যাংকটি ১ : ১ এর পরিবর্তে ৪ : ১ হারে রাইট শেয়ার ইস্যু করবে। অর্থাৎ বিদ্যমান প্রতি চারটি শেয়ারের বিপরীতে একটি শেয়ার ইস্যু করবে প্রতিষ্ঠানটি। আর এতে শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতি নিতে আগামী ১০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবে বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আহবান করা হয়েছে। ইজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতি পাওয়া গেলে রাইট শেয়ার ইস্যুর প্রস্তাব বিএসইসিতে জমা দেয়া হবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন সাপেক্ষে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বারবার ফোন দেয়া সত্তে¡ও আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ারকে পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, অনুমোদিত মূলধন ২ হাজার কোটি থেকে চার হাজার কোটি টাকা করা এবং পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের চারটি বিদ্যমান শেয়ারের বিপরীতে একটি রাইট শেয়ার ইস্যু করবে আইএফআইসি। এর আগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৫৬৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তখন একটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে একটি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে আরো ৫৬৩ কোটি ৮২ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হয়। নতুন করে রাইট ইস্যু করা হলে কোম্পানিটির মোট শেয়ার দাঁড়াবে ১৭০ কোটিরও বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতার অভাব, ব্যবসা করতে গিয়ে কোনো ধরনের লোকসানে পড়েছে সেসব কোম্পানি আপদকালীন সময় বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারে। তবে সব সময় বোনাস লভ্যাংশ দেয়া মানে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের ঠকানো। পাশাপাশি ডিভিডেন্ড গেইন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসইর তথ্যমতে, নিয়মিত মুনাফা করলেও সাতটি ব্যাংক গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিতই বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। যদিও এসব ব্যাংক মুনাফার অংশ বিনিয়োগ না করে রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির রিজার্ভের পরিমাণ ৭৭১ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটি টানা ১৬ বছর ধরে বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে বলেন, বারবার বোনাস লভ্যাংশ দেয়াটা কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়। এটাকে কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বলে আমি মনে করি না।

এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি বছর শেষে মুনাফার ওপর লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এ বিষয়ে কোন কোম্পানি কী পরিমাণ লভ্যাংশ দেবে তার কোনো নিয়ম নেই। এতে কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসা মন্দার কারণে বোনাস লভ্যাংশ দিচ্ছে, আবার কেউ ভালো মুনাফা করেও বোনাস দিচ্ছে। যেসব কোম্পানি ভালো মুনাফার পরও বোনাস দিচ্ছে তারা বিনিয়োগকারীদের ঠকাচ্ছে। লভ্যাংশের বিষয়ে নিয়মনীতি থাকলে এমনটি হতো না।

তিনি আরো বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিত বোনাস ও নগদ লভ্যাংশের বিষয়ে একটা নীতিমালা করে দেয়া। তাহলে কোনো কোম্পানি বছরের পর বছর বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো মূলধন বাড়াতে পারবে না।
লভ্যাংশ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, স্বচ্ছ কোম্পানি সবসময়ই নগদ লভ্যাংশ দেয়। যেসব কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি তেমন ভালো নয়, তারাই কেবল বোনাস লভ্যাংশ দেয়। আবার অনেক কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেও বিনিয়োগকারীদের ঠকাতে বোনাস লভ্যাংশ দেয়। বোনাস লভ্যাংশ দিতে দিতে এক সময় প্রতিষ্ঠান তলানিতে নেমে যায়। আর তাই নগদ লভ্যাংশ সবার জন্য ভালো।

জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএফআইসি ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন দুই হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ৩৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। বর্তমানে রিজার্ভে রয়েছে ৮৭১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। দুই বছরের মধ্যে দামের দিক থেকে তলানিতে অবস্থান করছে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার দর। গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর, ১৯) কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল অভিহিত মূল্যের নিচে। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ১৩৩ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭৩৫টি।

আইএফআইসি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মোট শেয়ার রয়েছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, সরকারের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের রয়েছে এক দশমিক ৭১ শতাংশ শেয়ার। উদ্যোক্তাদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ অনেক কম। সফলতার জন্য উদ্যোক্তাদের ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং সরকারের ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ মিলে মোট ৪১ দশমিক ৪৬ শতাংশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের নিজেদের শেয়ার হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে আইএফআইসি।

ঝুঁকি এড়াতে ৪৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা চেয়েছে আইএফআইসি : ঝুঁকি এড়াতে সরকারি মালিকানা শেয়ারের বিপরীতে বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে ৪৮২ কোটি ২৫ লাখ টাকা চেয়েছে বলে জানা গেছে। স¤প্রতি আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে এক চিঠি দিয়ে এ অর্থ দেয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে লেখা আইএফআইসির এমডির চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাসেল-৩ অনুসারে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধনের ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ মোট ঝুঁকি ভারিত পুঁজি (রিস্ক ওয়েটেড ক্যাপিটাল) হিসেবে দেখাতে হবে। ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসেই রেগুলেটরি ক্যাপিটাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। যার ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ঝুঁকি ভারিত পুঁজি হিসেবে দেখাতে হবে।

তবে বাড়তি শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ বা ৭০ কোটি টাকা সাব-অর্ডিনেট বন্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখন যদি আইএফআইসি ব্যাংকের মোট ক্যাপিটাল না বাড়ানো হয়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আইন ও ব্যাসেল ৩ মানতে হলে আইএফআইসি ব্যাংক আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।

খেলাপি ঠেকেছে ১,৪৬০ হাজার কোটি টাকা : চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ।