বদরুল হাসান: পুঁজিবাজারে জানুয়ারি মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে দরপতন অব্যাহত আছে। ডিএসই ব্রড ইনডেক্স এক পর্যায়ে পাঁচ হাজারের নিচেও নেমে যায়। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে এ বাজারের দৈন্যদশার এটাই শেষ না, এর কপালে আরও দুঃখ আছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর মাননীয় অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কুশীলব ও প্রাজ্ঞজনদের নিয়ে একটি সভা করেন।

দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ধরে আলোচনা শেষে ঐ সভায় প্রধান প্রধান যে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেগুলো হলো বাজারের স্থিতিশীলতা বাড়াতে লাভজনক সরকারি কারখানাগুলো সত্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হবে ও তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক এবং পরিচালন কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তাছাড়া প্রাথমিক

গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে আসা শেয়ারের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। মাননীয় মন্ত্রীর এই সভার পর বাজার পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ই-নি; বরং তা আরও দ্রুতলয়ে অবনতির দিকে যেতে থাকে। তিন চার দিন পর অবশ্য বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু এটা কতটা টেকসই হবে, সে সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কারণ মূলত তিনটি; প্রস্তাবিত কার্যক্রমগুলোর মেয়াদের অনুপযুক্ততা, বাজার সম্পর্কে জনমনে অস্বচ্ছতার বিভাব ও আস্থাহীনতা এবং বাজারে নিম্নমানের স্ক্রিপের ব্যাপক উপস্থিতি।

সভার সিদ্ধান্তগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে এগুলো প্রধানত দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ; স্বল্প মেয়াদে এসবের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। অথচ এ মুহূর্তে দরকার স্বল্পমেয়াদি কার্যকর সিদ্ধান্ত ও সেগুলোর দৃশ্যমান বাস্তবায়ন। ২০১০ সালের পর পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা আনতে অনেক নিয়মকানুন প্রবর্তন করা হয়; গঠন করা হয় ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল। কিন্তু ঐগুলোর বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও সক্রিয়তা আদৌ নেই।

পরিচালক প্রতি অন্যূন ২ শতাংশ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরসের অন্যূন ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে আগাম ঘোষণা দেওয়ার শর্ত রয়েছে। এটা অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারসাজিমূলক লেনদেনের জন্য দু’একটি ক্ষেত্রে কিছু শাস্তি দেওয়া হলেও অনেকেই সে সবকে গরু মেরে জুতা দান’-এর সঙ্গে তুলনা করেন।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে লবণের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার সময় জনৈক সংরক্ষণ কর্মকর্তার চাতুর্যের কথা মনে পড়ে। আট আনা সের লবণের দাম যখন ৩০ টাকায় ওঠে, তখন ঐ কর্মকর্তা তার তত্ত্বাবধানে থাকা ১,০০০ মন লবণ রাতের আঁধারে বিক্রি করে ১২ লাখ টাকা পকেটস্থ করে ফেলেন। অপরাধ ঢাকতে রাতেই লবণ লুটের একটি ভুয়া মামলা রুজু করেন। তত্ত্বাবধানে থাকা মালামাল খোয়া গেলে বা আত্মসাৎ হলে মালের মূল্য দ্বিগুণ হারে দায়ী কর্মকর্তার কাছ থেকে আদায় করার নিয়ম ছিল। এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হারে তার দায় দাঁড়ায় মাত্র ৪০ হাজার টাকা।

তিনি নাকি তদবির চালিয়ে তার কাছ থেকে টাকা আদায়ের আদেশটি বের করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পরিচালকের কামরা থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন। শাস্তি লাভজনক হলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি শুধু চলতেই থাকবে না, বরং তা আরও বাড়তে থাকবে, এটা তো সবার জানা। আইপিও (ওহরঃরধষ চঁনষরপ ঙভভবৎরহম)-এর মাধ্যমে বহু নিম্নমানের কোম্পানিকে কাগজে-কলমে মোটাতাজা করে উচ্চমূল্যে ঐগুলোর শেয়ার বিনিয়োগকারীদের হাতে গছিয়ে দেওয়ার অভিযোগ এন্তার।

এখন বাজারে প্রায় সাড়ে তিনশ’ স্ক্রিপ কেনাবেচা হয়; এর এক-তৃতীয়াংশের মূল্য হয় ফেইস ভেলুর নিচে, না হয় দুই তিন টাকা ওপরে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এসব অভিযোগ দেখার জন্য তৃতীয় কোনো কর্র্তৃপক্ষ নেই। এখানে সুশাসনের লেশমাত্র নেই; ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়। কিন্তু এখানে সবকিছু একদেশদর্শী; এখানে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা ভিন্নতা কিছু আনতে পারে না।

পুঁজিবাজারের ওপর আস্থাহীনতা একদিনে তৈরি হয়নি। কথা আর কাজের মধ্যে মিল না থাকায় দিন দিন এই আস্থাহীনতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনকানুন অনেক, কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ নেই। ছাত্রাবস্থায় টিফিনের সময় আমরা দুই বন্ধু একবার এক ফ্যাক্টরি দেখার মানসে তার গেইটে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। ঐ ফ্যাক্টরির দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করায় সে “প্রবেশ নিষেধ” সাইনবোর্ডের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এরপর অনেক অযাচিত লোককে খিড়কি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে তাদের বারণ না করার কারণ জানতে চাইলাম। তার সোজা প্রত্যুত্তর, “তারা তো তাকে জিজ্ঞাসা করেননি”। পুঁজিবাজারের অবস্থা দেখে ঐ ঘটনাটি বারবার মানসপটে ভেসে ওঠে।

বিএসইসি সুন্দর সুন্দর নিয়মকানুন জারি করে আত্মতুষ্টিতে আছে। ভাবছে সবাই সুবোধ বালকের মতো সেগুলো পালন করবেন। এর মধ্যে কিছু দুর্দম দুর্বৃত্ত কথা না শুনলে বা জিজ্ঞাসা না করলে তাদের কী করার আছে?

মাননীয় অর্থমন্ত্রী এর আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে তার ভেতর-বাহির সুন্দর করে সাজিয়ে তোলেন; স্বপ্নময় কথা আর ছবির সমাবেশ সে সাজসজ্জাকে করে তোলে আরও অপরূপ। তার জ্ঞান-গরিমা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা সেখানে তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণের পরিমাণ না বাড়তে দেওয়ার যে অঙ্গীকার তিনি ব্যক্ত করেছিলেন,তা রক্ষিত হয়নি; বছর ঘোরার আগেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এগুলো আস্থাহীনতার ক্ষেত্র প্রসারিত করে। কথা ও কাজের মিলই আস্থার জন্ম দেয়, বিশ্বস্ততা বাড়ায়।

লাভজনক সরকারি কলকারখানাগুলোর শেয়ার বিক্রি করার আহ্বান ও সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে আমরা শুনতে পাচ্ছি। এবারের সভায় সে সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ়তর হয়েছে। এটা করা গেলে বাজারের স্থিতিশীলতা নিঃসন্দেহে বাড়বে। তবে এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া যত সহজ, বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন; তবে অসম্ভব নয়। সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক হলেও এর বাস্তবায়ন অনেকটাই নির্ভর করে আমলাদের ওপর। এটা করা হলে আমলাদের স্বার্থ ও ক্ষমতা দুইই খর্ব হতে বাধ্য। আর ব্যক্তিগত ও শ্রেণিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগের মানসিকতা কম মানুষের মধ্যেই থাকে। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৯৬ সালে যানজটে আক্রান্ত কুয়ালালামপুর (কখ) থেকে দেশের রাজধানী পুত্রাজায়ায় স্থানান্তরের কাজে আমলাদের কাছ থেকে অনুরূপ বাধার সম্মুখীন হন। রাজধানী স্থানান্তরের এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে নিন্দুকেরা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য করে ফেলার অভিযোগ আনেন। আমলারও তাতে সায় দেন।

মাহাথিরের পরিকল্পনা ছিল রাষ্ট্রীয় খাজাঞ্চিখানা থেকে এক কপর্দক ব্যয় না করে কুয়াললামপুরের দুর্মূল্য জমি ও ভবন বিক্রির অর্থে নতুন এই মেগা প্রকল্প সম্পন্ন করা। কিন্তু আমলাদের অসহযোগিতার কারণে তিনি ঐ কৌশল প্রয়োগ করতে পারেননি। অভিজ্ঞ ব্যবসাবান্ধব মন্ত্রী মহোদয়ের অঙ্গীকার দেখে মনে হচ্ছে যে, এক্ষেত্রে সফলতা আসার সময় এখনই; অন্য কোনো সময় নয়।

বাংলাদেশ কেইন্সিও মডেলে সরকারি ব্যয়ে উন্নয়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাক লাগানো উন্নয়নধারা বজায় রাখায় অনেক বোদ্ধার কাছে এদেশ উন্নয়ন গবেষণা ও প্রাক্কলনের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দেশের বাজেটের আকার পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু দ্রুততম সময়ে ধনবান তৈরির এই দেশে কর দেন মাত্র বিশ বাইশ লাখ লোক।

কাজেই প্রতি বছর বাজেট ঘাটতি একটি সাধারণ ব্যপার। ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বাইরের উৎস থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিচ্ছেন। সুদ-জিডিপি অনুপাত এখন ১৭ এর কাছে চলে গেছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা ও পেনশনে এখন প্রায় ২৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সুদ বাবদ ব্যয়ও ১৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বাজেটে উন্নয়ন খাতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। চলমান দশ এগারটি মেগা প্রকল্পে অর্থসংস্থান করতে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকা অলস টাকা সরকারি খাতে স্থানান্তরের কথা সরকার চিন্তা করছে। রাজপথের ওপর নতুন করে কর আরোপের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এগুলো সবই জন-অসন্তোষ উদ্রেককারী অর্থ আহরণ প্রক্রিয়া। অথচ পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করে সহজেই জনপ্রিয় পন্থায় এসব প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা যায়।

আগের একটি লেখাতেও বলেছিলাম যে, যে মানুষ কর দিতে চায় না, সেও বিনিয়োগ করতে চায়। সুশাসন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও তার ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ ও দক্ষ করা গেলে অর্থের জোগান কোনো সমস্যা নয়। দেশ থেকে পুঁজি পাচারের যে অভিযোগ রয়েছে, তা বন্ধ করা গেলে উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থায়ন সহজলভ্য হতে পারে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরের বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়ের অর্থ সিন্ধুতে পরিণত করে মেগা প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন করা সম্ভব। উন্নত করপোরেট সংস্কৃতির চর্চা শুরু হলে এসব সমাপ্ত প্রকল্প থেকে যে কর আসবে, তার পরিমাণ ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর থেকে অনেক বেশি হবে।

অধিকন্তু জনসাধারণ এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করায় দেশের উন্নয়নে তাদের অংশীদারত্ব বাড়বে; বাড়বে দেশপ্রেম। কিন্তু এখানে বারবার প্রতারিত হওয়ায় মানুষ পুঁজিবাজারবিমুখ হয়ে পড়ছেন। আতঙ্ক দূর করে শেয়াবাজারের ওপর মানুষকে আস্থাশীল করতে প্রয়োজন দুষ্ট ক্ষতে মলম লাগানোর পরিবর্তে শল্য চিকিৎসা প্রয়োগ; যাতে দুরারোগ্য কর্কট রোগ চিরতরে নির্মূল হয়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগে দৃশ্যমান শুদ্ধি অভিযানে মানুষ যেমন স্বস্তি পেয়েছেন, তেমনি পুঁজিবাজারের দুর্বৃত্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অপনোদন করা গেলে এখানেও আস্থা ফিরে আসবে। বিচার বিভাগের ইতিবাচক প্রভাব সমাজে অভিক্ষেপ করার জন্য বলা হয় যে, “শুধু ন্যায়বিচার করাই যথেষ্ট নয়, ন্যায়বিচার যে করা হচ্ছে তা দৃশ্যমান করতে হবে।”

বদরুল হাসান, খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক

rulhanpasha@gmail.com