দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় জোরালো ভূমিকা রাখতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এ খাতের বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্ন বিধিবিধান থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে সুবিধা পেলেও আইসিবির বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে মন্দার সময়ে সহায়তার বিপরীতে উল্টো শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ব্যাংক খাতের তারল্য সংকটের জেরে ২০১৮ সাল থেকেই পুঁজিবাজারে মন্দা দেখা দেয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর পুঁজিবাজারের সংকটকালীন সময় থেকেই আইসিবির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে শেয়ার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। গত চার মাসেই এ প্রতিষ্ঠানটি ৩৩০ কোটি টাকার বেশি নিট বিক্রি করেছে। অব্যাহত বিক্রিচাপে এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৬২৩ পয়েন্ট কমে ৪৯৪৭ পয়েন্টে নেমে এসেছে। সূচক ৩৩ মাস পর আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চাপ বেড়েছে। রাস্তায় বিনিয়োগকারীরা আন্দোলন করেছেন।

অব্যাহতভাবে শেয়ার বিক্রির প্রবণতার কারণে গত দুই বছরে পুঁজিবাজারে আইসিবির পোর্টফোলিওতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। যদিও এ সময়ে আইসিবিকে বিভিন্নভাবে তহবিলের জোগান দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে আইসিবির গত দুই বছরের পোর্টফোলিও পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে পুঁজিবাজারে আইসিবির বিনিয়োগ ব্যয় ছিল ১০ হাজার ৭২ কোটি টাকা, যার বাজারমূল্য ছিল ১০ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে পুঁজিবাজারে আইসিবির বিনিয়োগ ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, যার বাজারমূল্য ছিল ১০ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

চলতি বছরের ৩১ মার্চের হিসাবে বাজারমূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিও নেমে আসে ১০ হাজার ১২৪ কোটি টাকায়। নিট বিনিয়োগ না থাকায় আইসিবির পোর্টফোলিও মূল্য না বাড়ার বদলে উল্টো কমেছে বলে জানা গেছে। পুঁজিবাজারের মন্দায় আইসিবির সক্ষমতা বাড়াতে বন্ডের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের বড় অংশই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার কথা। এছাড়া ২০১৮ সালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এর বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের তহবিল থেকে চলতি বছর আইসিবিকে বড় অংকের অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন ধরনের অর্থ সহায়তা পেলেও ব্যাংকঋণের সুদ ও মিউচুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশের অর্থ জোগাতে শেয়ার বিক্রি করতে হচ্ছে বলে দাবি করেছে আইসিবি।

স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ২২ মে থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইসিবির দুটি বিও (বেনিফিসিয়ারি ওনার্স) হিসাব থেকে ১১৭ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে ৩৬৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করা হয়। এতে ওই দুই বিও হিসাব থেকে নিট শেয়ার বিক্রি করা হয় ২৪৮ কোটি টাকার। একই সময়ে আইসিবি ইউনিট ফান্ডের বিও হিসাব থেকে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে ১৮৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে।

এ বিও হিসাব থেকে নিট শেয়ার বিক্রি হয় ৫২ কোটি টাকা। এছাড়া আইসিবি বন্ডের বিও হিসাব থেকে নিট শেয়ার বিক্রি হয় ১৮ কোটি টাকার। গত এক সপ্তাহে আইসিবি থেকে আরও ১৩ কোটি টাকারও বেশি নিট বিক্রি করে। সব মিলিয়ে গত ২৩ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত শেয়ার বিক্রি করে ৩৩০ কোটি টাকারও বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত এ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন বলেন, আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য এ রকমটা হতেই পারে। আমাদের প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো সুদ পরিশোধ করতে হয়। আমাদের কাছে যারা এফডিআর করেছেন, সেটাও নগদায়ন করতে হয়। মিউচুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ দিতে হয়। অন্য ব্যাংক থেকে আমাদের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এসব অর্থ আমরা কোথা থেকে দেব। আমরা কিন্তু শুধু বিক্রি করছি না, শেয়ার ক্রয়ও করছি। গত এক মাসে আমরা বিক্রি বাদে ১০০ কোটি টাকার নিট ক্রয় করেছি।

পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নে আবুল হোসেন বলেন, তহবিল রয়েছে। আমরা বিনিয়োগও করছি। তবে বিভিন্ন ধরনের ব্যয়ের কারণে মাঝে মধ্যে শেয়ার বিক্রি করতে হয়। এক বছরের চিত্র যদি নেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে শেয়ার বিক্রির চেয়ে আমাদের ক্রয় বেশি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সহায়তা বাবদ যে অর্থ আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা তিন মাস অন্তর তাদেরকে ফেরত দিতে হয় এবং পরবর্তীকালে আবারও দেওয়া হয়। তবে এ প্রক্রিয়ার জন্য আমাদেরকে শেয়ার বিক্রি করতে হয়। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বাজারকে সহায়তা করার জন্য।

এজন্য সবসময় শেয়ার ক্রয় করার অর্থ তো আমাদের নেই। এটাও বিবেচনায় নিতে হবে। তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও ২৭২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে আইসিবির। এর মধ্যে মার্জিন ঋণবাবদ প্রায় ৩১৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া ব্রিজ লোন, বন্ড, ডিবেঞ্চারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মূল্য কমে গেলে কোনো সঞ্চিতি রাখতে হয় না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে এ বিষয়ে আইসিবিকে অব্যাহতি দেওয়া আছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত অন্তত ৩৫টি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে আইসিবি। এ কারণে বিভিন্ন কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগেই জানার সুযোগ রয়েছে।

এদিকে বিএসইসিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুঁজিবাজারে আইসিবির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। তিনি বলেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনব। তাদেরকে যে তহবিল দেওয়া হয়েছে তা বাজারকে সাপোর্ট না দিয়ে, অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটা করা যাবে না বলে স্পষ্টভাবে তিনি বলেছেন।