এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনেক গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করতে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসলেও এর কোনো কার্যকর ফলাফল মিলছে না। বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০১৭ সালে ৮ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে বিএসইসি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, যখন নতুন একটি কোম্পানি ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ভালো দেখেই সে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। কিন্ত হঠাৎ সেটি খারাপ অবস্থানে চলে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা লোকসানে পড়েন। গত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।  তাহলে বিনিয়োগ শিক্ষা তাদের কতটা কাজে আসছে এবং এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের পর বাজারে ইকুইটির পরিমাণ তিনগুণ বেড়েছে এবং এখনো বাজারে ইকুইটি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে না। বাজার ভালো করতে হলে বিনিয়োগকারী আনতে হবে। শুধু ব্যাংক থেকে ফান্ড এলে বাজার ভালো করা যাবে না। বিএসইসি বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বিনিয়োগ শিক্ষা বা যে কোনো শিক্ষাই উপকারী।

কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কোনো বিষয়টি আগে বা পরে প্রয়োজন সেটি বিবেচনা করতে হবে। যখন নতুন একটি কোম্পানি তার ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন বিনিয়োগকারীরা ভালো দেখেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। কিন্ত হঠাৎ করে সেটি খারাপ অবস্থানে চলে যায়। তাহলে বিনিয়োগ শিক্ষা কতটা কার্যকর বা এর প্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

বাজার সংশ্লিষ্ট বলছেন, পুঁজিবাজারে মূলধন বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগ শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষা নিজের মূলধনের সুরক্ষার পাশাপাশি মুনাফার ক্ষেত্রেও সুযোগ তৈরি করবে। আর আর্থিক সাক্ষরতা না থাকলে মূলধন হারানোর ঝুঁকিও থাকে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্র বলছে, দেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের অর্ধেকের বেশি আর্থিক সাক্ষরতা নেই। তারা বড় কোনো বিনিয়োগকারীকে অনুসরণ করে বিনিয়োগ করে। অনেক সময় গুজবনির্ভর শেয়ার কেনাবেচা করতে গিয়ে মূলধনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এ জন্য বিনিয়োগকারীকে সাক্ষর করতে মূলত এই কর্মসূচি হাতে নেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সাক্ষরতা ও বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ২০১৬-১৭ সালে স্বল্পমেয়াদে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা, বিচারক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আইনজীবী, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের টার্গেট করা হয়।

মধ্যমেয়াদে ২০১৮-১৯ সালে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী; সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী; এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্য পেশাজীবী এবং মধ্যম আয়ের জনগণ এবং দীর্ঘমেয়াদে ২০২০-২১ সালে গৃহিণী; অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, ব্যবসায়ী; শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ জনগণ বিনিয়োগ শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমে একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নিলেও এর ধারে কাছে যেতে পারেনি কমিশন। মূলত একটি ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এই প্রশিক্ষণে রাজধানীর ঢাকার বিনিয়োগকারীরাই সুযোগ পাচ্ছে; তবে সেটা খুব স্বল্প পরিসরে।
কমিশন সূত্র জানায়, বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে দুই বছর ৯ মাসে প্রায় ৩৭ হাজার বিনিয়োগকারী প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছে। ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসের ১৮ হাজার পাঁচজন বিনিয়োগকারী শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়। ২০১৮ সালে এক বছরে ১৫ হাজার ৫২৮ জন এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ৪৮১ জন বিনিয়োগ শিক্ষা গ্রহণ করেছে।

সেন্টাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্র জানা যায়, বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সংখ্যা ২৫ লাখ ৫০ হাজার। তিন বছর আগে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৩০ লাখের বেশি। ভালো কোম্পানি না আসা ও আস্থাহীনতা থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছাড়ছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

এ বিষয় ফিনিক্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সাবেক এমডি এ কাদির চৌধুরী বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারে যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছে, এতে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিনিয়োগকারীর আস্থার সংকট, ইনসাইডার ট্রেডিং ব্যাপকভাবে হচ্ছে। এ ছাড়া ভালো শেয়ারের অভাব প্রকট। বেশিরভাগই নিম্নমানের কোম্পানি। ভালো কোম্পানি আনা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন উপায়ে বাজারে কারসাজি চলছে। এ বিষয়গুলো যদি সমাধান করা না যায়, তাহলে বাজার কিভাবে ভালো হবে? এখন সময় এসেছে, এখান থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘ভালো কোম্পানি না আসায় বিনিয়োগকারী আস্থা পাচ্ছে না। মন্দাবস্থার কারণে অনেকে লোকসানে পড়েছেন। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না পারায় যা আছে, তাই নিয়েই বাজার ছাড়ছে তারা। পুঁজিবাজারে ক্রমাগত পতনে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। আস্থা ফেরানো সম্ভব না হলে বাজারে গতি ফেরানো অসম্ভব।