এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে। টানা দরপতনে পুঁজি হারাচ্ছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজারের বর্তমান অবস্থা ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালের ধসকেও হার মানিয়েছে। ওই দুই সময়ের ধসে বড় ধরনের সংস্কার এবং প্রণোদনা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের দেখার কেউ নেই। এ অবস্থায় পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। ফলে নীরব কান্না চলছে পুঁজিবাজারে।

পুঁজিবাজারের এক ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী আহসান হাবীব। গত ৭ জুলাই ডেল্টা স্পিনার্সের শেয়ার কিনেছেন ৬ টাকা ৭০ পয়সায়। গতকাল সেই শেয়ারের মূল্য কমে ৪ টাকা ১০ পয়সায় নেমেছে। আলোচ্য সময়ে তিনি পুঁজি খুইয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ। আহসান হাবীব বলেন, এ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কমেছে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই। এ ভাবে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর কোন কারন ছাড়া টানা কমছে। এর ফলে ঋণগ্রস্ত অনেক বিনিয়োগকারী মূলধন খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

কারণ, ঋণের টাকা আদায়ে ঋণদাতা অনেক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীর পত্রকোষ বা পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সড সেল) করে দিয়েছেন। তাতে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ঋণের অর্থ ফেরত পেলেও অনেক বিনিয়োগকারী মূলধন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। পুঁজিবাজারে পতন শুরু হয়েছে গত জানুয়ারি থেকে। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর কিছুদিন সূচকের বড় ধরনের উত্থান ঘটে। এরপর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে বাজারে পতন শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকালও সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে দুই বাজারে সূচকের বড় ধরনের পতন ঘটে। সেই সঙ্গে লেনদেনও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।

এছাড়া পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে (আইপিও) নতুন কোম্পানিগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই বেশি প্রিমিয়াম নিয়ে অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে আসছে। আর রেগুলেটররা হরদম এসব কোম্পানির অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে বাজারে আসার পর প্রথম কয়েকমাস তিন থেকে চারগুণ বেশি দামে শেয়ার বিক্রি হলেও পরে তা ফেসভ্যালুতে আবার অনেকগুলো তারও নিচে নেমে আসছে। এতে করে একদিকে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। অন্যদিলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হেলাল বলেন, এ বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ তিন থেকে সাড়ে তিনগুণ বেশি। আর বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার লোক আছে, কিন্তু বাজারে টাকা বিনিয়োগের লোক কম। তাই আইপিও একদম বন্ধ করে দিতে হবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসার আগে তিন-চার বছর তেমন কোনো লভ্যাংশ না দিলেও বাজারে এসেই বোনাস শেয়ার ইস্যু করছে। আর তাদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা সেই বোনাস শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। কিন্তু পুনরায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে না। ফলে বাজারে শেয়ার মূল্য পতন হচ্ছে। আর এভাবে অর্থ চলে যাচ্ছে আর বাজারও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।

কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারের বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থার সংকট, সুশাসনের অভাব ও অতিরিক্ত সরবরাহ। এগুলো সমাধানের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেই সরকারের। এদিকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দরপতন চলছেই। প্রতিদিনই কমছে সূচক। লেনদেনেও চলছে খরা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের আশ্বাস এবং তারল্য সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না।

অন্যদিকে শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খোদ স্টক ব্রোকার মালিকরা। তাদের ব্যবসা সংকোচনের নামে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছেন। একজন ব্রোকার মালিক জানান, ২০১০ সালের পর দীর্ঘ সময়ে লোকসান দিয়ে হাউস পরিচালনা করেছেন। এর পর কোম্পানির রিজার্ভ থেকে কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করেছেন। এখন রিজার্ভের খাতা শূন্যের কোঠায় নামছে। ফলে বাধ্য হয়েই কর্মী ছাঁটাইয়ে যেতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অব্যাহত দরপতনে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই এখন লোকসানে। লোকসান আরও বাড়বে এমন শঙ্কায় অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বিক্রির চাপ বেড়ে দরপতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিক্রির চাপ বাড়লেও তা সামাল দেওয়ার জন্য যে সহায়তা দরকার, তা বাজারে নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষমতা হারিয়েছে আগেই। বেসরকারি বাণিজ্যিক ও মার্চেন্ট ব্যাংক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও সাইডলাইনে। স্টক এক্সচেঞ্জের ডিলার অ্যাকাউন্টগুলো আগে থেকেই শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন, মূলত তিনটি কারণে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন হচ্ছে। কারণ তিনটি হচ্ছে, তারল্য সংকট, আর্থিক খাতের খারাপ অবস্থা এবং গ্রামীণফোনের সমস্যার সমাধান না হওয়া।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য সংকট আছে সেটা রয়ে গেছে। ব্যাংকের সুদের হার এখনও বেশি। এটার নেতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারে আছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অবস্থা বেশ কিছুদিন ধরে খারাপ। পুঁজিবাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ হচ্ছে এই আর্থিক খাত। ব্যাংক-লিজিং সবগুলোর শেয়ারের দাম কমছে। ফলে সূচক কমেছে।

শাকিল রিজভী মনে করেন, বাজারে এখন আস্থার সংকটই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর এই তিন সমস্যা দূর না হলে বাজারে আস্থা ফিরবে না। বাজার স্বাভাবিক হবে না। গত ২২ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে ব্যাংকগুলোকে আরও বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওতে সরাসরি বিনিয়োগ অথবা সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে এই বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার আগে ১৬ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজার নিয়ে বাজারের অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কমাল।

৩০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’ উদযাপনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেছিলেন, সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব শিগগিরই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। কিছু ভালো লাভজনক প্রতিষ্ঠান দু-এক মাসের মধ্যেই বাজারে আসবে। কিন্তু কোনো আশ্বাসই পুজিবাজারে ইতিবাচক ফল আনতে পারছে না।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন উচ্চ প্রিমিয়ামে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের আইপিও অনুমোদন করেছে তার মধ্যে ২৪টির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। এমনকি লেনদেন শুরুর পর এক বছর পার হওয়ার আগেই শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

বাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে একের পর এক দুর্বল কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। ফলে আইপিওতে উচ্চ প্রিমিয়াম নেয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো- কোম্পানিগুলো যোগ্যতার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম পেয়েছে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপশি সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘পুঁজিবাজারে শুদ্ধি অভিযান’ এখন সময়ের দাবি বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১০ সালে পুঁজিবাজারে মহাধসের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে দেশের পুঁজিবাজার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১১ সালের মে মাসে এম খায়রুল হোসেনকে বিএসইসির চেয়ারম্যান করে বর্তমান কমিশন গঠন করে। এরপর টানা আট বছর খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে। এ আট বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ৪৬টি কোম্পানি প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিওতে শেয়ার ছেড়েছে। এর মধ্যে ২৪টির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে দুটির দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমেছে। এছাড়া পাঁচটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের কাছাকাছি অবস্থান করছে।

প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিওতে আসার পরও শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিষ্ঠান দুটি হলো: জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও অ্যাপোলো ইস্পাত। ২০১১ সালে আইপিও অনুমোদন পাওয়া জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২৫ টাকা দামে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি ১৫ টাকা প্রিমিয়াম নেয়।

বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৬০ পয়সায়। প্রিমিয়াম নেয়ার পরও শেয়ারের দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া অপর প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো ইস্পাত ২০১৩ সালে আইপিওর মাধ্যমে বাজার থেকে ২২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এ টাকা উত্তোলনের জন্য কোম্পানিটি ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে প্রিমিয়াম নেয় ১২ টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয় ২২ টাকায়। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ৬০ পয়সায়।

চলতি বছর তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়েছে দুটি কোম্পানি। এর মধ্যে একটির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে যাওয়া এস্কয়ার নিট কম্পোজিট আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এজন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি প্রিমিয়াম পেয়েছে ৩০ টাকা। চলতি বছরের এপ্রিলে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৩ টাকা ৬০ পয়সায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের মধ্যে শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পতনের কারণে বাজারে ব্যাপকভাবে ফোর্সড সেল শুরু হয়েছে। ফলে বাজারে এখন চরম ক্রেতাসংকট তৈরি হয়েছে। এমনিতেই নতুন বিনিয়োগ আসছে না বাজারে। তার ওপর বিক্রির চাপ বেড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে। এতে বাছবিচার ছাড়া সব ধরনের শেয়ারেরই ব্যাপক দরপতন ঘটছে। এমনকি ভালো লভ্যাংশ ঘোষণার পরও অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে।