মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পকেট কাটছে এখন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো লিমিটেড। দরপতন পুঁজিবাজারে যেখানে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে রাইট শেয়ারের অনুমোদনের দরকার কি এমন মন্তব্য বিনিয়োগকারীদের। দরপতন পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের কথা না ভেবে তাদের নিজেদের আখের গোছাতে শুরু করছে। তেমনি রাইট দিয়ে গোল্ডেন হারভেস্ট পকেট কাটার ব্যবস্থা করেছে।

পুঁজিবাজারে রাইট শেয়ার উত্তোলনের নামে হরিলুট চলছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। কারন কোম্পানিগুলো রাইটের নামে কোম্পানির উন্নয়নের কথা বললেও নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করছে। তেমনি পুঁজিবাজারে রাইট শেয়ার ছেড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। গত সাত বছরে প্রায় ৩০টি কোম্পানি শেয়ার ইস্যু করে এ অর্থ উত্তোলন করা হয়।

কিন্তু আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারেনি অধিকাংশ কোম্পানি। উল্টো ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ১০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার ইস্যু করে কোনো রকম ‘এ’ ক্যাটেগরি ধরে রেখেছে।

রাইট শেয়ার ইস্যু করা কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদরের অবস্থাও নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর অবস্থান করছে অভিহিত দরের কাছাকাছি। আর তিনটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর অভিহিত দরের নিচে নেমে গেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান রাইট শেয়ার ছাড়ার অনুমতি পায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাইট শেয়ার ইস্যু করে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মালিকই কোম্পানির উন্নয়নের কাজে এ অর্থ ব্যবহার না করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করেন। তাদের কোনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনাও থাকে না। রাইটের মাধ্যমে এ অর্থ উত্তোলন সহজলভ্য বলে তারা সুযোগটি গ্রহণ করে। তবে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো এই অর্থ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করে। তারা সফলও হয়।

এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডাররাও যার সুবিধা পান। আর বছর শেষে তারা শেয়ারহোল্ডারদের সন্তোষজনক লভ্যাংশ দেওয়ার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে যাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থাকে না কিংবা ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে, তাদের কোম্পানির কোনো উন্নতি হয় না। ফলে এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এক সময় বিপদে পড়তে হয় বিনিয়োগকারীদের। এটা এক ধরনের প্রতারণা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত সাত বছরে রাইট শেয়ারের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তাল্লু স্পিনিং, ফনিক্স ফাইন্যান্স, পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ফাস ফাইন্যান্স ও ন্যাশনাল হাউজিং অর্থ সংগ্রহ করে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফার্স্ট লিজিং ফাইন্যান্স (বর্তমান ফার্স্ট ফাইন্যান্স), আরামিট সিমেন্ট, জেনারেশন নেক্সট, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং ব্র্যাক ব্যাংক পুঁজিবাজার থেকে রাইটের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে।

আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ডেল্টা স্পিনার্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক ও আইসিবি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুটি প্রতিষ্ঠান রাইট শেয়ার ছেড়ে অর্থ উত্তোলন করে। কোম্পানি দুটি হচ্ছে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ও জিপিএইচ ইস্পাত। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাইটের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে বিডি থাই, আইডিএলসি, সাইফ পাওয়ার টেক ও আইএফআইসি ব্যাংক। একইভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অর্থ সংগ্রহ করে ইফাদ অটোস, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার থেকে আইপিও কিংবা রাইটের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে, তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থাকা দরকার। যাদের পরিকল্পনা থাকে, তারা এই অর্থ নিয়ে ভালো করতে পারেন। কিন্তু যারা কোনো পরিকল্পনা করে চলেন না, তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এই অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের।

২০১২-১৩ অর্থবছরে রাইটের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তাল্লু স্পিনিং। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারেনি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে। প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ না থাকায় অভিহিত দরের নিচে চলে গেছে দর। বর্তমানে এ শেয়ার সর্বোচ্চ চার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একই অবস্থা বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিজ ফাইন্যান্সের। ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে নেমে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এ শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ২.২০ টাকায়। একইভাবে ‘জেড’ ক্যাটেগরির ফার্স্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারও ৩ টাকায় ঘরে কেনাবেচা হচ্ছে। এছাড়া অভিহিত দরের নিচে লেনদেন হচ্ছে বস্ত্র খাতের জেনারেশন নেক্সটের শেয়ার।

এদিকে রাইট শেয়ারের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি রাইট শেয়ার ছাড়ার পর আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠান ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে কোনোরকম ক্যাটেগরি টিকিয়ে রেখেছে।

স¤প্রতি গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো লিমিটেডর রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সূত্র মতে,কোম্পানিটির ৩:৪ ( অর্থাৎ ৩টি রাইট শেয়ার দিবে ৪টি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে) হারে রাইট ইস্যু করবে। অভিহিত মূল্যে এই শেয়ার কিনতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা। রাইটের মাধ্যমে কোম্পানিটি ৮ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার ৩৪২টি শেয়ার ইস্যু করবে।

এর মাধ্যমে কোম্পানিটি ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা তুলবে। রাইটের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ দিয়ে কোম্পানিটি ব্যবসা স¤প্রসারণ, ডিস্ট্রিবিউশন চ্যালেন এবং ঋণ পরিশোধ করবে।

কোম্পানিটির ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে রয়েছে ব্যানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টেমন্ট এবং আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজেমন্ট লিমিটেড। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ হিসাব অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৬৪ পয়সা। আর শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ২২ টাকা ৯৬ পয়সা।