দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মানসম্মত কোম্পানির তালিকাভুক্তি কমে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে এখন দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের প্রাচুর্য। ২০১০ সালের বিশাল ধসের পর বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে চাহিদার তুলনায় শেয়ারের সরবরাহ খুব কম। তাই সহজেই বাজারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা যায়, ফলে ধস অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। সুতরাং পরিস্থিতির উন্নতি চাইলে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

তাদের এই পরামর্শ মেনে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) গত ৯ বছরে পুঁজিবাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোম্পানির মান ও হিসাবের স্বচ্ছতার দিকে নজর দেয়নি মোটেই। ফলে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বাজার সয়লাব। অন্যদিকে নড়বড়ে বাজারে ক্রমাগত পুঁজি হারিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আস্থার সংকটও।

অভিযোগ আছে, নি¤œমানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি, অযৌক্তিক প্রিমিয়াম ও লাগামহীন প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের অনুমতির মাধ্যমে কিছু কোম্পানিকে টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে পুঁজিবাজারকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন এসইসির কর্তাব্যক্তিরা। অচেনা, স্বল্প পরিচিত বিভিন্ন কোম্পানি আইপিও প্রসপেক্টাসে তথ্য অতিরঞ্জিত ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখালেও কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের আসল চিত্র বেরিয়ে এসেছে।

ফলে আইপিওর অনুমোদন পাওয়ার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয়ে (ইপিএস) মারাত্মক অবনতি দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া ‘রাইট শেয়ার’ ইস্যুর মাধ্যমেও অযৌক্তিকভাবে বাজারে শেয়ার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাজার চিত্রে সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও পুঁজিবাজারের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মোট ৭১টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি বা ৫৩ শতাংশ কোম্পানিই ছিল নি¤œমানের। ফলশ্রæতিতে উৎপাদন বন্ধ ও লোকসানের কারণে তালিকাভুক্ত হওয়ার ২-৪ বছরের মধ্যেই ১০টি কোম্পানি ‘জেড ক্যাটাগরি’তে নেমে এসেছে। এগুলো হচ্ছে সিএন্ডএ টেক্সটাইল, ঢাকা ডায়িং, এমারল্ড অয়েল, ইভিন্স টেক্সটাইল, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিবিবি পাওয়ার, আইএসএন লিমিটেড, খুলনা পেপার, পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও তুংহাই ডায়িং।

আইপিওর মাধ্যমে বর্তমান কমিশন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলনের অনুমতি দেয় কোম্পানিগুলোকে। এর বাইরে রাইট ও রিপিট পাবলিক অফারের (আরপিও) মাধ্যমে আরো হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দেয়া হয়। প্রিমিয়াম পেতে যেসব কোম্পানি আয় বাড়িয়ে দেখিয়েছিল, সেগুলোর বড় অংশের আয়ই কমে গেছে। কোনো কোনো কোম্পানি পড়েছে লোকসানেও।
২০১২ সালে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে তালিকাভুক্ত জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনের

ইপিএস ছিল ২ টাকা ৯ পয়সা, ২০১৮ সাল শেষে যা দাঁড়িয়েছে ৪৩ পয়সায়। গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এই কোম্পানি প্রতিটি শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে ২ টাকা ৬০ পয়সায়। জিবিবি পাওয়ার ৩০ টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতি শেয়ার ৪০ টাকায় বরাদ্দ মূল্যে তালিকাভুক্ত হয়। সে সময় ইপিএস ছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা, যা চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে দাঁড়িয়েছে ৭৬ পয়সায়। ২০১৮ সালে কোনো লভ্যাংশ দিতে না পারায় জেড ক্যাটাগরিতে নেমে আসা এ কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার গতকাল লেনদেন হয়েছে ১২ টাকা ৭০ পয়সায়। একই সময়ে তালিকাভুক্ত পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সও এখন জেড ক্যাটাগরিতে। ইপিএস কমেছে এনভয় টেক্সটাইলস, ইউনিক হোটেল এন্ড রিসোর্টস, আমরা টেকনোলজিস ও সায়হাম কটন মিলস লিমিটেডের।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আপত্তি সত্তে¡ও প্রতি শেয়ার ২২ টাকা বরাদ্দ মূল্যে ২০১৩ সালে আইপিওর অনুমোদন পায় অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্স। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানিটি ইপিএস দেখায় ২ টাকা ৩৬ পয়সা। তালিকাভুক্তির পাঁচ বছরে লোকসানে পড়ে কোম্পানিটি। গতকাল এর শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে ৪ টাকা ৭০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে। একই সময়ে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে। এর শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের চার ভাগের এক ভাগ দামে (২.৪০ টাকা) কেনাবেচা হচ্ছে।

প্রতি শেয়ার ৩৫ টাকা বরাদ্দ মূল্যে ২০১৪ সালে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে হামিদ ফ্যাব্রিক্স লিমিটেড। তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৫ টাকা ৫৮ পয়সা যা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ২৫ পয়সা। ইপিএস কমে যাওয়ায় বর্তমানে এ কোম্পানির শেয়ার দর নেমে এসেছে বরাদ্দ মূল্যের নিচে ১৬ টাকা ৫০ পয়সায়। একই বছরে তালিকাভুক্তির সময় প্রিমিয়ামে আসা খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ লিমিটেডের ইপিএস ছিল ১ টাকা ৬৭ পয়সা, যা সমাপ্ত বছরে মাত্র ২৫ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

চলতি বছর তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়েছে দুটি কোম্পানি। এর মধ্যে একটির শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে। শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে যাওয়া এস্কয়ার নিট কম্পোজিট আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। এ জন্য ১০ টাকা দামের একটি শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানিটি প্রিমিয়াম পেয়েছে ৩০ টাকা।

চলতি বছরের এপ্রিলে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩০ টাকা ৬০ পয়সা। বর্তমান কমিশনের আমলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অথবা রাইট শেয়া ইস্যু করা বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর এখন তলানিতে রয়েছে। সাধারণত ডিভিডেন্ড মৌসুম এলে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ে। কিন্তু চলতি ডিভিডেন্ড মৌসুমে শেয়ারদর বাড়ার পরিবর্তে উল্টো কমেছে। আর এই প্রবণতায় কমছে অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারদরও।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। তিন দিক থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে শেয়ার বেড়ে বাজার অবমূল্যায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাছবিচার না করে দুর্বল কোম্পানির তালিকাভুক্তি। তা ছাড়া রাইট শেয়ারের মাধ্যমেও শেয়ার সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেছে।

তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু কোম্পানি বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রির ঘোষণা। এসব কারণে পুঁজিবাজারে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কতটা সময়ের মধ্যে বিক্রি করা যাবে সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আবারো ভাবতে হবে। এ ছাড়া যেসব কোম্পানির শেয়ার দর ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে তাদের বাইব্যাক করতে হবে।

ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ক্রমাগত রাইট শেয়ারের কারণে বাজারে শেয়ার বেড়েছে। এমন অনেক কোম্পানি ধারাবাহিক বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে আসছে। কিন্তু কোম্পানির ব্যবসা বাড়ছে না। এতে কোম্পানি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এসব কোম্পানি কি করে লভ্যাংশ দেবে? এ ছাড়া পুঁজিবাজারে অনিয়ম হলে শুধু তদন্ত হয় বিনিয়োগকারী আর ব্রোকারেজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোম্পানি কারা আনল, কারা ধারাবাহিক বোনাস শেয়ার ইস্যু করে কোম্পানিকে দুর্বল করে দিল তাদের বিষয়ে তদন্ত হয় না। যার কারণে সমস্যা আর শেষ হয় না।

মানহীন কোম্পানির অতিরিক্ত শেয়ার সরবরাহের বাইরেও পুঁজিবাজারের বর্তমান নাজুক অবস্থার জন্য আরো কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম।  তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের এই অবস্থার জন্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট। এর মূলে রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির কিছু ঝামেলা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যার প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের অন্যতম খাত ব্যাংকের অবস্থা ভালো নেই।