দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ তুলছেন বিনিয়োগকারীরা। অভিযুক্ত সিন্ডিকেটের কাছেই এখনো জিম্মি পুঁজিবাজার। চিহ্নিত এই কারসাজি সিন্ডিকেট কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। দিনের পর দিন একই ধরনের শেয়ার কারসাজি করে চলছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে বড় ধরনের কারসাজির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব ব্যক্তির নাম এসেছিল তারা এখনো নিয়ন্ত্রক কারসাজির। প্রতিকারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষও কোনো কিছুই করতে পারছে না। মামলা, জরিমানা করার পরও তাদের কারসাজি থামছে না। পুঁজিবাজারে এখন এদের পরিচয় শেয়ার কারসাজির মাফিয়া সিন্ডিকেট হিসেবে।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ৫ বছরেও বোনাস শেয়ার থেকে বের হতে পারছে না জাহিন স্পিনিং। বরং ডিভিডেন্ডের নামে কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে কোম্পানিটি। কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের টাকায় ব্যবসা করে বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করছে। ব্যবসার টাকা নিজেরা রেখে দিয়ে বছর শেষে ডিভিডেন্ডের নামে কাগজ দিচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্যও বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে কোম্পানিটি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর প্রতিবছরই কোম্পানিটি মুনাফার শতভাগ রেখে দিচ্ছে। তারপরেও নিয়মিতভাবে কমছে মুনাফা ও লভ্যাংশ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে হঠাৎ পুঁজিবাজারে ‘আলাদিনের চেরাগ’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে জাহিন স্পিনিং লিমিটেড। সাত কার্যদিবসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে প্রায় ৫৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। একটি বিশেষ চক্র কারসাজির মাধ্যমে এ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯) শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) কমেছে ৬৪ শতাংশ। সাধারন বিনিয়োগকারীদেরকে ফাদেঁ ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য একটি চক্র শেয়ারটির উত্থানে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া এ কোম্পানির কারসাজির সাথে কোম্পানির পরিচালকদের সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে নানা সুত্রে জানা গেছে। মালিকপক্ষ ইপিএস খারাপ দেখিয়ে শেয়ার হাতিয়ে নিয়ে নতুন করে কারসাজি ধান্দায় মেতে উঠছেন। চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ০.১০ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ইপিএস হয়েছিল ০.২৮ টাকা। এ হিসাবে ইপিএস কমেছে ০.১৮ টাকা বা ৬৪ শতাংশ। তারপরেও শেয়ারটি টানা উত্থানে রয়েছে। অন্যদিকে গত ২৪ নভেম্বর জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ার দর ছিল ৫.৯০ টাকা। যা ২ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে দাড়িঁয়েছে ৯.২০ টাকা। এ হিসাবে ৭ কার্যদিবসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৩.৪০ টাকা বা ৫৭ শতাংশ।

এদিকে গতকাল জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ার দর উত্থানে রয়েছে। গতকাল শেয়ারটি ১০.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। এর আগে কোম্পানিটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রান্তিকগুলোতে ধারাবাহিকভাবে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) কমেছে। কোম্পানিটির ওই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৮) ০.৩১ টাকার ইপিএস দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৮) কমে হয় ০.১৯ টাকা। যা তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ ১৯) ০.১৩ টাকা ও চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন ১৯) ০.০৫ টাকা হয়। এরমাধ্যমে পুরো অর্থবছরটিতে ইপিএস হয়েছে ০.৬৩ টাকা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরে ছিল ১.১৭ টাকা। তালিকাভুক্তির ৫ বছরেও বোনাস শেয়ার থেকে বের হতে পারেনি জাহিন স্পিনিং। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবসায়ও বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে কোম্পানিটির পর্ষদ। এভাবে কোম্পানিটির পর্ষদ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পরে প্রতিবছরই মুনাফার শতভাগ রেখে দিচ্ছে। তারপরেও নিয়মিতভাবে মুনাফা ও লভ্যাংশ কমছে। এই কোম্পানিটি প্রতিটি ১০ টাকা করে ২টি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে ১টি রাইট শেয়ার ইস্যু করতে চায়। এক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে ৪ কোটি ৯২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৫০টি রাইট শেয়ার ছেড়ে ৪৯ কোটি ২৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা উত্তোলন করতে চায়। অথচ কোম্পানিটির শেয়ার সেকেন্ডারি মার্কেটে অভিহিত মূল্যের নিচে পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে গত বছরের ৭ মার্চ কোম্পানিটি ১টি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে ১টি রাইট ইস্যুর মাধ্যমে ৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ২৭ হাজার টাকা উত্তোলন করার অনুমতি পেয়েছিল। এ জন্য প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ টাকা। তবে গতবছরের ২২ জুলাই কোম্পানির আবেদনের প্রেক্ষিতে রাইট শেয়ারের সাবস্ক্রিপশন পূর্ব-নির্ধারিত তারিখ বাতিল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোম্পানিটিকে সিকিউরিটিজ আইন পরিপালনপূর্বক পুনরায় সংশোধিত রাইটস শেয়ার প্রস্তাবের আবেদন কমিশনে দাখিল করতে বলা হয়।

বিশ্লেকরা মনে করছেন, একটি কোম্পানি যখন কোনো ধরণের এক্সপানশন ছাড়াই শুধু স্টক ডিভিডেন্ড দিতে থাকে তখন সেগুলোতে বিনিয়োগ না করাই ভাল। তার ওপর যদি পরিচালকদের বোনাস বিক্রির ঘোষণা থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। এক পর্যায়ে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌছায় শুধুমাত্র কাগজ ধরিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কারণ কোম্পানির পেইড আপ আর ব্যবসার সাথে কোন ধরণের সংগতি থাকে না।

এ বিষয় জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা পরিকল্পিতভাবে কারসাজির উদ্দেশ্যেই স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। স্টক ডিভিডেন্ড দিয়ে কোম্পানিটি কারসাজিতে মেতে উঠছে। কোনর কারন ছাড়াই ৫৬ শতাংশ দর বাড়া যোক্তিক নয়।

এছাড়া কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার পাশাপাশি কোম্পানির ব্যবসায়ের প্রত্যেকটি ইস্যু (যেমন- পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসির তথ্য) সঠিকভাবে যাচাই করা উচিত। এছাড়া কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার হোল্ডারদের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি প্লেসমেন্টধারীদের সঙ্গে উদ্যোক্তা পরিচালদের সাথে কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা- তা যাচাই করে দেখা উচিত।

তিনি আরও বলেন, কোম্পানির পরিচালকেরা বছরের বছর পর স্টক ডিভিডেন্ড দিয়ে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিওতে শেয়ার যোগ করবে, আর নিজেরা বসে বসে ঘি খাবে তা হতে পারে না। বর্তমান পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলো অনেক জবাবদিহিতার আওতায় এসেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এই বিষয়টিও বিএসইসির বিবেচনায় আনার আহ্বান জানান তিনি।