এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি একটিভ ফাইন কেমিক্যালস লিমিটেডের বিরুদ্ধে শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতারনার অভিযোগ উঠছে। কোম্পানিটির নানা অনিয়মের আংিশক অভিযোগ তুলে ধরছে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ। কোম্পানিটি সমাপ্ত অর্থবছরে ডিভিডেন্ডের নামে বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করছে। কোম্পানিটি ক্যাটাগরি ধরে রাখার জন্য নামমাত্র ডিভিডেন্ড দিয়েছে। এছাড়া গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোম্পানিটির ইপিএস হঠাৎ কমার কারণ কি এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একদিকে কোম্পানির ইপিএস কমছে, অন্যদিকে ডিভিডেন্ড কমছে।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন একটিভ ফাইন সমাপ্ত অর্থবছরে ৭১ কোটি মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের নামমাত্রা ২ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। এর পুরোটাই নগদ ডিভিডেন্ড। কিন্তু কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের মাত্র ৫ কোটি টাকা বা ৭ শতাংশের কম মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি ৯৩ শতাংশ মুনাফা কোম্পানিতেই রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পুঁজিবাজারের রীতি-নীতির পরিপন্থী। কোম্পানিটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতারণা করছে বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছে। বিনিয়োগকারীদের টাকায় কোম্পানিগুলো ব্যবসায় করলেও বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত ডিভিডেন্ড থেকে বঞ্চিত করছে। এ কোম্পানির ইপিএস ও ডিভিডেন্ড বিষয় তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিটির আলোচিত সময়ে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২ টাকা ৯৭ পয়সা।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেন, একটিভ ফাইন ৭১ কোটি টাকা মুনাফা করলে কি ভাবে ২ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেয়। এরচেয়ে কম মুনাফা করা কোম্পানি এবার ভাল ডিভিডেন্ড দিয়েছে। কোম্পানিটির ডিভিডেন্ড ও ইপিএস নিয়ে আমাদের ভোদগম্য নয়। এ কোম্পানিটি ইপিএস ও ডিভিডেন্ডের নামে প্রতারনা করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কে বিষয়টি তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো সাধারণত মুনাফার ৬০ শতাংশের বেশি শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করছে। কোন কোন কোম্পানি মুনাফার ৯০ শতাংশ পর্যন্তও বিতরণ করছে। দু’তিনটি কোম্পানি লোকসান থাকার পরও রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে। কিন্তু কোন কারণ ছাড়া মুনাফার ৭ শতাংশের কম শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ এটি একটি বিরল ঘটনা। তাঁরা বলছেন, এভাবে মুনাফার ৯৩ শতাংশের বেশি কোম্পানির কাছে রেখে দেয়ার পেছনে কোম্পানির পরিচালকদের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখা উচিত বলে তাঁরা মনে করেন।

ডিএসই সুত্রে জানা গেছে, একটিভ ফাইন কেমিক্যালসের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবসায় প্রায় ৭১ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। তবে কোম্পানিটির পর্ষদ এই মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে মাত্র ৫ কোটি টাকা বা মুনাফার ৭ শতাংশ লভ্যাংশ আকারে বিতরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি ৯৩ শতাংশ কোম্পানিতেই রাখা হবে। তবে আগামি অর্থবছর থেকে ৭০ শতাংশের বেশি রিজার্ভে রাখার ক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে অতিরিক্ত কর গুণতে হবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেট অনুযায়ি, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি কোনো অর্থবছরে কর পরবর্তী নিট লাভের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ রিজার্ভে স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হবে। যদি কোনো কোম্পানি এরূপ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রতিবছর রিজার্ভে সরবরাহকৃত অংশের উপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। যা আগামি অর্থবছর থেকে কার্যকর হবে।

একটিভ ফাইনের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ২.৯৭ টাকা হিসেবে মোট ৭১ কোটি ২৬ লাখ টাকার নিট মুনাফা হয়েছে। এরমধ্য থেকে ২ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ০.২০ টাকা হিসাবে মোট ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার নগদ লভ্যাংশ বিতরন করা হবে। অর্থাৎ মুনাফার ৬.৭৪ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরন করা হবে। মুনাফার বাকি ৬৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বা ৯৩.২৬ শতাংশ রিজার্ভে রাখা হবে। ২৩৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের একটিভ ফাইনে ১৩৫ কোটি ৫ লাখ টাকার রিজার্ভ রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে আরো দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিটি ধারাবাহিক মুনাফা করছে। গত পাঁচ বছরে ধরে কোম্পানিটির মুনাফা ধারাবাহিক বাড়লেও সে হারে ডিভিডেন্ড বাড়েনি। এর মধ্যে কোম্পানিটি ২০১৫ সালে মুনাফা করে ৪৫ কোটি ৫৬ লাখ ৮ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৭ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৬ সালে মুনাফা করে ৬৭ কোটি ৮১ লাখ ৭ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৫ টাকা ৫১ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৭ সালে মুনাফা করে ৫৫ কোটি ৩৮ লাখ ৯ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৪৬ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৮ সালে মুনাফা করে ৮২ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ৪ টাকা ১৩ পয়সা। কোম্পানিটি ২০১৯ সালে মুনাফা করে ৭১ কোটি টাকা। ঐ সময় কোম্পানির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৯৭ পয়সা। এছাড়া কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি সম্পদ ধারাবাহিক ভাবে কমছে। এর মধ্যে কোম্পানিটির ২০১৫ সালে সম্পদ ছিল ২৬ টাকা ৮১ পয়সা, ২০১৬ সালে সম্পদ ছিল ২৮ টাকা ৫২ পয়সা, ২০১৭ সালে সম্পদ ছিল ২৪ টাকা ৪৫ পয়সা, ২০১৮ সালে সম্পদ ছিল ২৩ টাকা ৬৯ পয়সা।

এ ব্যাপারে বিনিয়োগকারী আজমত উল্লাহ বলেন, পুঁজিবাজারে এমনই স্মরনকালের ধ্বসে সাধারন বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমন অবস্থায় একটিভ ফাইনের মতো একটি ভালো কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের সাথে ডিভিডেন্ড ও ইপিএস নিয়ে প্রতারনা করছে। কোম্পানিটি ধারাবাহিক ভালো মুনাফা করলেও এবার ইপিএস ও ডিভিডেন্ডে ধ্বস নামছে। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, বিনিয়োগকারীদের কোম্পানির প্রতি যদি আস্থা না থাকে তা হলে পুঁজিবাজারে কিসের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করবে। একটিভ বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারনা করছে। এ কোম্পানির এমডি থেকে পরিচালনা পর্যদের সকলের শাস্তি হওয়া উচিত।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, একটিভ ফাইন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরারা আজ সর্বশান্ত। এটা পুঁজিবাজার নয়, লুটের বাজার। এসব প্রতারক পরিচালকদের শাস্তি দাবী নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ পুঁজিবাজারের হবে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সেরা পুঁজিবাজার। কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা ফ্রড (প্রতারক)। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।

এ কারণে বর্তমানে পুঁজিবাজারে এমন দুরবস্থা বিরাজ করছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যখন নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না, তখন বিনিয়োগকারীদেরকেই নিজের পুঁজি রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা না করে গুটিকয়েক লোকের স্বার্থ হাসিলের সুযোগ করে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের উচিত ওইসব দুর্বল কোম্পানির শেয়ার না কেনা। বিনিয়োগকারীরা টাকা দিয়ে কেন দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনবে?