দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : বেসরকারি উদ্যোক্তারা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য বিদেশী ঋণ নিলে তিন মাস পর থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ কমাতে ২০১৪ সালে এমন নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের চাপে এ নির্দেশনা সংশোধন করে নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। এখন বিদেশী ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে সর্বোচ্চ এক বছর করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কিস্তির পরিবর্তে একবারে পরিশোধ করলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর কিছুটা চাপ বাড়লেও স্বস্তিতে থাকবেন উদ্যোক্তারা। তারা বাড়তি সময় পাবেন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে।

জানা গেছে, টাকার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারছিল না ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে ২০১১ সালের দিকে ব্যাংকিং খাতের এ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় স্থানীয় ঋণের সুদহারও বেড়ে যায়। এমনি পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেকটা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীরা বিদেশী ঋণের প্রতি অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এর ফলে রাতারাতি বাড়তে থাকে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ। সঙ্কটকালীন সময়ের জন্য এটা করা হলেও বৈদেশিক ঋণের লাগাম আর টেনে ধরতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের দায় প্রায় ১৫ বিলিয়ন অর্থাৎ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় অর্ধেক দায় সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত ব্যবসায়ীরা এক বছরের কম সময়ের জন্য বা স্বল্পকালীন এবং এক বছরের বেশি সময়ের জন্য বা দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনতে থাকেন।

নানা ধরনের সার্কুলার দিয়ে এটা সহনীয় রাখার চেষ্টা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমাতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার নীতি বিভাগ থেকে এক সার্কুলার জারি করা হয়। এতে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনলেই তিন মাস পর থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এতে বাদ সাধেন ব্যবসায়ীরা। তারা দীর্ঘ দিন ধরে স্বল্প মেয়াদের বৈদেশিক ঋণ মেয়াদ শেষে এককালীন পরিশোধে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ব্যবসায়ীদের দাবিও অনেকটা যৌক্তিক বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বৈদেশিক ঋণ আনার তিন মাসের মাথায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা ব্যবসায়ীদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ কারণে প্রতিনিয়তই ব্যবসায়ীরা এ নীতিমালা লঙ্ঘন করে আসছেন। তিন মাস পর কিস্তি পরিশোধ না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে সময় বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ২০১৪ সালের নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। তবে এর সুবিধাভোগী হবেন কেবল শিল্পের কাঁচামাল আমদানিকারকরা। যারা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য স্বল্প মেয়াদে অর্থাৎ সর্বোচ্চ এক বছরের মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ গ্রহণ করেন কেবল তারাই তিন মাসের পরিবর্তে এক বছরের মাথায় একসাথে সুদে আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক সার্কুলার জারি করে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে অবহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সাধারণত ব্যবসায়ীরা বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনলে তা সুদে আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এ ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত কারণে মেয়াদ শেষে সুদহার বেড়ে যায়। যেমন প্রতি ডলার ৮৪ টাকার বিনিময় মূল্যের সময় একজন ব্যবসায়ী ঋণ নিলেন। এক বছর বা পাঁচ বছর মেয়াদি ঋণ নিলে মেয়াদ শেষে পরিশোধের সময় প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৯০ টাকা হলো। যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়, তখন মুদ্রার বিনিময় মূল্যের কারণে প্রকৃত সুদহার অনেক বেড়ে যায়। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিলে প্রকৃত অর্থে লাভ হয়; কিন্তু বৈদেশিক ঋণ এক বছরের বেশি সময়ের জন্য নিলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ বিডার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ অনুমোদনের ঝামেলা এড়াতে উদ্যোক্তারা স্বল্প মেয়াদেই বেশি হারে বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছেন, এতে বৈদেশিক মুদ্রার দায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।