মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ক্যাসিনোর চেয়েও বড় আতঙ্কের নাম পুঁজিবাজার। নিঃস্ব লাখ লাখ পরিবার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতিদিনই হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন। শুধু পুঁজিবাজারে যে কৌশলে ৭৪ হাজার কোটি টাকা পুঁজি উধাও হয়ে গেছে। এর ফলে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। শুধু বিনিয়োগকারী নয়, শেয়ারবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণে সর্বস্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার নারীও তার সঞ্চয়ের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলেছে। ব্রোকারেজ হাউসের কয়েক হাজার চাকরিজীবীও দিশেহারা। চাকরি নেই, তাই চলছে না সংসারের চাকাও।

মিশন থেকে ফিরে আসা বহু কর্মকর্তার বিপুল অংকের টাকাও খোয়া গেছে এই রাক্ষুসী শেয়ারবাজারে। বিপরীতে বহাল তবিয়তে আছে ডাকসাইটে ডাকাতরা। যারা বারবার শেয়ারবাজারে ইচ্ছেমতো লুটপাট চালিয়েছে। এছাড়া শুধু দেশের মানুষের নয়, শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে এসে চীনা কোম্পানিরও তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। চক্রটির লুটপাট এমন স্তরে গিয়ে ঠেকেছে যে, তারা ৫০ টাকার শেয়ার ২ টাকায় নিয়ে এসেছে। এর কারণটাও হতবাক করার মতো।

সর্বস্ব খুইয়ে তারা জানতে পেরেছে ৫০ টাকা দিয়ে যে শেয়ার কেনা হয়েছে সেই কোম্পনির কোনো অস্তিত্বই নেই। এর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তার দায় কোনোভাবে এড়াতে পারে না। কেননা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা করতে তাদেরকে বসানো হয়েছে।

প্রথম লুটপাট হয়েছে দুর্বল কোম্পানির অনুমোদন ও বেপরোয়া প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের মাধ্যমে। বাজারে এমন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ যারা লুট করেছেন, তাদের অনেকেই সভা, সমাবেশ ও সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে মানুষকে জ্ঞান দিচ্ছেন। ব্যবসা বাণিজ্যসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির উন্নয়নেও তারা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এমন দৃশ্য দেখে সরকারের ওপর ভুক্তভোগীদের ক্ষোভের ঝাঁজ আরও বাড়ছে।

তাদের কয়েকজন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে জানিয়েছেন, অনতিবিলম্বে তাদেরকে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে একদিন গণআদালতে এদের বিচার হবেই হবে। ইতিমধ্যে এছাড়া বিনিয়োগকারীরা সংবাদ সম্মেলন করে এদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে।এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার সুশাসন চায়, এটা বোঝাতে সবার আগে রাঘব-বোয়ালদের গ্রেফতার করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, শেয়ারবাজারের সংকট একদিনের নয়। অনেক দিন থেকে চলে আসছে। যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক, মূল সমস্যা হল এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। কারণ বিভিন্ন সময়ে যারা বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের বিচার হয়নি। ফলে আস্থা ফিরে আনতে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যত শক্তিশালী হোক এবং যে পদেই থাকুক তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, শেয়ারবাজারসহ সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাত দুর্বৃত্তদের দখলে। ফলে ক্যাসিনোর মতো এখানে বড় অভিযান চালাতে হবে। এক্ষেত্রে অন্য কেউ নয়, প্রধানমন্ত্রীকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের এমন একটি বার্তা দিতে হবে, যে কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হয়। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান নেয়া ছাড়া আমি এর সমাধান দেখি না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বর্তমান সংকট যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ও সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতের সুশাসনের অভাব, প্রভাবশালীদের চাপে আইপিওতে (প্রাথমিক শেয়ার) নামসর্বস্ব দুর্বল কোম্পানি আসা, বেপরোয়া প্লেসমেন্ট (বাজারে আসার আগে শেয়ার বিক্রি) বাণিজ্য, বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও তারল্য সংকট, তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির আয় কমে যাওয়া,

সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির নিষ্ক্রিয়তা, কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া এবং সাম্প্রতিক নেয়া পদক্ষেপগুলো সময় উপযোগী ও কার্যকর না হওয়া। এছাড়াও কোম্পানির অডিট রিপোর্টেও জালিয়াতি রয়েছে। তাদের মতে, সাম্প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কারণে বড় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ আড়ালে চলে গেছে। ফলে লেনদেনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শেয়ারবাজারে দুষ্টচক্রের দুষ্ট কার্যক্রম নতুন করে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারল্য সংকটের কারণে বাজারে সমস্যা। কিন্তু এটি ঠিক নয়। কারণ মূল সমস্যা সুশাসনের অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। এছাড়াও কোম্পানিগুলোর আয় কমছে। এদিকে পুঁজিবাজার থেকে যে ভাবে উধাও হয়েছে হাজার কোটি টাকা তার মধ্যে ২০/৩০ টি কোম্পানি থেকে বেশি টাকা উথাও হয়ে যায়। এর মধ্যে ১০ কোম্পানি কৌশলে বড় ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে একটি কোম্পানি ইনটেক লিমিটেড।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। তারা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন যে আর কোনো ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ড সভায় যে ঘটনা ঘটছে, তাও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা অশনিসংকেত। কেন যেন বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই প্রতিযোগিতা করে দুঃশাসন নিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।

সার্বিক বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন বলেন, উত্থান-পতন পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু এখন পুঁজিবাজারে যা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একটি গ্রুপ ‘অগানাইজড ওয়েতে’ বাজার চালাচ্ছে। এদিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানি ইনটেক লিমিটেড। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ছিল ৫৬ দশমিক ২০ টাকা। ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি সেই কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ৪৩ দশমিক ২০ টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকায়। অর্থাৎ এ কোম্পানির ৩ কোটি ১৩ লাখ ২১ হাজার ২২৬টি শেয়ারধারী বিনিয়োগকারীদের ১৩৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ৯৬৩ টাকা উধাও হয়ে গেছে।