দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের স্বার্থে ৫টি মূলনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলেও সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি’) পুঁজিবাজারে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে অনাকাক্ষিত ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকান্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পুঁজিবাজারের দুঃসময়ে সহযোগিতা করা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও নিজস্ব পোর্টফোলিওকে পঁচা শেয়ারের ভাগাড়ে পরিণত করা প্রতিষ্ঠানটি নিজেই দূরবস্থায়।

এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে সাপোর্ট দেওয়াতো দূরের কথা, আইসিবির নিজস্ব দুরবস্থারোধে দরকার আরেকটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারে বর্তমানে ৩৫৭টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। যেখানে কোন ধরনের বিচার-বিশ্লেষন ছাড়াই প্রায় সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে অর্থ সংকটে পড়েছে আইসিবি। এই তালিকায় ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটের (ওটিসি) কোম্পানি, ‘জেড’ ক্যাটাগরি ও উৎপাদন বন্ধ থাকা এমন অসংখ্য কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া এমন কোম্পানিতেও বিনিয়োগ রয়েছে, যার নাম অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশেষ করে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দায়িত্ব হলেও দীর্ঘ নয় বছরেরও অধিক সময় ধরে সংকট উত্তরণে আইসিবির দৃশত তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করলে পুঁজিবাজারের এ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বরং অসাধু কিছু কর্মকর্তারা তারা নিজেদের আখের গেছাতে ব্যস্ত। আইসিবি এখন ডাম্পিং শেয়ারের কারখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনায়নে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। সে হিসেবে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করলে বাজার ইতিবাচক ধারায় অনেক আগেই ফিরত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ বিনিয়োগকারীর ভূমিকা পালন করছে। আইসিবি অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ করে প্রতি অর্থবছরেই রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। আইসিবি সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতো অতি মুনাফার আশা করে।

তবে এবারে প্রতিষ্ঠানটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই প্রথমবারের মতো বাজার ভালো না হওয়ায় বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে আইসিবি। মুনাফার পরিবর্তে চলতি অর্থবছরের তিন মাসের হিসাবে লোকসান করেছে ১৩৪ কোটি টাকা। এদিকে, পুঁজিবাজার উন্নয়ন এবং তারল্য প্রবাহ স্থিতিশীল রাখতে ২০১৮-২০১৯ হিসাব বছরে আইসিবির সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে কর্মসম্পাদন চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি আইসিবি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিষ্টেম বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আইসিবির বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে কোন কার্যকরি নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না। এরা অন্ধভাবে বিনিয়োগ করেছে। অথবা এরা কারসাজিমূলক বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে হয়তো আইসিবির ম্যানেজম্যান্টের ব্যক্তিগত লাভজনক সর্ম্পক আছে।

অন্যথায় এ ধরনের দুর্বল, সুশাসনবিহীন ও আর্থিকভাবে দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ বোধগম্য নয়। এছাড়া তারা কেনো সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে, এটাও আমার কাছে বোধগম্য নয়। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিবির বিশ্লেষণ থাকা উচিত ছিল। তিনি বলেন, আইসিবি তৈরী করা হয়েছিল শেয়ারবাজার উন্নয়ন করার জন্য। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডের ব্যর্থতায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আইসিবিকে অকার্যকর বলব না, প্রতিষ্ঠানটিকে অকার্যকর করা হয়েছে।

পুঁজিবাজারে আইসিবির ভূমিকা অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। পুঁজিবাজারে দুঃসময়ে ক্রয় বাড়ানো দরকার হলেও আইসিবির পক্ষে তা সম্ভব হয় না। যতবারই প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্নভাবে অর্থ সহযোগিতা দেওয়া হোক না কেনো, কোনবারই তার প্রতিফলন শেয়ারবাজারে দেখা যায় না। যে প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের স্বার্থ উদ্ধারে পঁচা শেয়ারের পার্কিংয়ের দায়িত্ব পালন করে বলে অভিযোগ আছে। তাইতো এখন আইসিবিকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে শেয়ারবাজারের স্বার্থে বর্তমান ভঙ্গুর আইসিবিকে শক্তিশালী করা অথবা বিকল্প বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবি সব মহলের।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যই আইসিবির জন্ম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর নিজের মুনাফা বাড়াতে ব্যস্ত থাকে। তারা পুঁজিবাজারে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরম ক্ষুব্ধ। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিকে বিনিয়োগে আসতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে কত টাকা বিনিয়োগ করেছে এটিও প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আইসিবির বিরুদ্ধে দুর্বল ও বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কেনার অভিযোগ শুনে আসছি। এছাড়া গেম্বলারদের স্বার্থে উচ্চ দরে নতুন শেয়ার কিনে পার্কিং করার অভিযোগও আছে। এ অভিযোগ থেকে বিগত কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করা আইসিবির কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালকই (এমডি) বের হতে পারেননি। এই বিষয়টি স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে পরিস্কার করার জন্য তদন্ত করা উচিত।

ডিএসইর আরেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা নিয়ে আইসিবি অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যক্তিগত স্বার্থে লাভের জন্য এমনটি করা হয় বলে অভিযোগ আছে। কোম্পানিটির ২০১৯ সালের ৩০ জুনের পোর্টফোলিও’র মাধ্যমে সেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এই প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা থেকে আইসিবির কোন এমডি বেরিয়ে আসতে পারেনি। জবাবদিহিতার অভাবে এমনটি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে জবাবদিহিতা ছাড়া আইসিবিকে কোন অর্থ দেওয়া যৌক্তিক হবে না। একইসঙ্গে আইসিবিকে বর্তমান দুরবস্থায় আনার পেছনে কাদের অবদান রয়েছে, তা খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। এজন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করা উচিত।

আইসিবির এককভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৭৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা মুনাফা হলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নেমে এসেছে ২৯ কোটি ২২ লাখ টাকায়। যে কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯) সাবসিডিয়ারিসহ লোকসান হয়েছে ১৩৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। শেয়ারবাজারের মন্দায় যার পরিমাণ ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ১৯) দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে আইসিবির শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ৪টি পোর্টফোলিও রয়েছে। এরমধ্যে ১ নম্বর পোর্টফোলিও’র মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ৭ হাজার ৭৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই পোর্টফোলিও থেকে তালিকাভুক্ত ২৮৫টি কোম্পানিতে এই বিনিয়োগ করা হয়েছে। এক নম্বর পোর্টফোলিও থেকে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের সবকটিতেই বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া সিমেন্ট খাতের ৭টি, সিরামিক খাতের ৪টি, প্রকৌশল খাতের ২৮টি, খাদ্য ও বিবিধ খাতের ২০টি, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের ১৬টি, বস্ত্র খাতের ৫০টি, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ৬টি, বীমা খাতের ৩০টি, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের ১৯টি,

বিবিধ খাতের ১৪টি, লিজিং খাতের ১৭টি, পেপার অ্যান্ড প্রিন্টিং খাতের ২টি, ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩০টি, সেবা ও আবাসন খাতের ৪টি, ট্যানারি খাতের ৪টি, টেলিকমিউনিকেশন খাতের ২টি এবং ভ্রমন ও অবকাশ খাতের ২টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেষে আইসিবির তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যার বাজার দর আছে ৯ হাজার ৫৯৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ৮৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা বা ৮ শতাংশ আনরিয়েলাইজড লোকসানে রয়েছে।

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, তাদের ১ হাজার কোটি টাকার মতো লোকসানে রয়েছে। এখানে রিয়েলাইজড বা আনরিয়েলাইজড বলে কিছু নেই। বাজার দর কমে তারা এখন লোকসানে, এটাই সত্য। আর এই সত্যকে স্বীকার করলে আইসিবির ইক্যুইটি থাকবে না। আইএফআরএস অনুযায়ি প্রভিশনিং করলে ইক্যুইটি শূন্য এবং দেউলিয়া হয়ে যাবে। এটা খুবই দুঃখজনক যে, আইসিবির মতো একটি প্রতিষ্ঠান এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে।

আইসিবির পোর্টফোলিও-১ এ তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ৭ হাজার ৭৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি ১ হাজার ১৭৯ কোটি ৪ লাখ টাকার ডিবেঞ্চার, অতালিকাভুক্ত কোম্পানি, তালিকাচ্যুত কোম্পানি ও প্রিফারেন্স শেয়ার কেনা হয়েছে। এছাড়া পোর্টফোলিও-২ এ ২ হাজার ৬৭৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, পোর্টফোলিও-৩ এ ১ হাজার ১৮৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা ও পোর্টফোলিও-৪ এ ২৮৮ কোটি টাকা তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও বগুড়া শাখা, লোকাল অফিস ও উত্তরা শাখার মাধ্যমে ১৪৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, ওইসব শেয়ারগুলো অনেক আগে থেকেই ছিল। যখন নেওয়া হয়েছিল ঠিক ছিল, এখন সব একাকার হয়ে গেছে। তবে এ বিষয়টি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে পারি না এবং সুযোগ হয় না। এ নিয়ে কিছু সমস্যাও আছে। ভবিষ্যতে এগুলো কিভাবে সমাধান করা যায়, সে চেষ্টা করব। মন্ত্রণালয় ও বিশ্লেষক দলের সঙ্গে আলাপ করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব। সুত্র: বিজনেস আওয়ার