এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পাঁচ কোটি টাকা বা তারও বেশি খেলাপি ঋণ ক্রয় বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। যদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই খেলাপি ঋণ সরকারি বা বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির (পিএএমসি) কাছে বিক্রি করে দিতে পারবে।

এ জন্য পিএএমসি আইন প্রণয়ন করছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অ্যাক্ট নামে একটি খসড়া আইন প্রস্তুত করেছে। খসড়া আইনটি এখন কার্যকর করার কাজ চলছে। আইন প্রণয়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের চার কর্মকর্তা কাজ করছেন। এদিকে বেড়েই চলেছে আর্থিক খাতের ‘বিষফোড়া’খ্যাত খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে এ মুহূর্তে এর পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। তবে প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বাড়তি মূলধন রাখত হচ্ছে, অন্যদিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হচ্ছে প্রভিশন। এতে ব্যাংকগুলোর অর্থ আটকে থাকছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আইন প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘তাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন কার্যকর করা। তবে পিএএমসি কার্যকর করতে কমপক্ষে ছয় মাসের বেশি সময় লাগতে পারে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, যদি এ কোম্পানি খেলাপি ঋণ আদায় করতে সমর্থ হয় তবে আদায়কৃত ঋণের অর্থের ২০, ৩০ এমনকি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হবে কোম্পানিকে। এ জন্য করা হচ্ছে আইন। এই আইন বলে ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ঋণ খেলাপির প্রতিষ্ঠান দখলে নিতে পারবে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াকে। এসব দেশে কীভাবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায় করা হচ্ছে তা পর্যালোচনা করে সেই আদলে গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির গঠন প্রক্রিয়া।

খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রস্তাবিত কোম্পানির কাজ কী হবে- তা জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি করবে। চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংক যে খেলাপি ঋণগুলো আদায়ে ব্যর্থ হয় সেগুলোর হিসাব কোম্পানির কাছে ট্রান্সফার করে দেবে। আর এ ঋণগুলো আদায়ে ব্যবস্থা নেবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি।

প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে কোম্পানিটির এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। খসড়া আইনানুযায়ী, ‘পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ সময়ে সময়ে বাড়ানো হবে। প্রয়োজনে পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করা হবে। পিএএমসি স্থানীয় এবং বিদেশি উভয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর মূলধন এবং তহবিল বাড়ানোর জন্য চুক্তি করার অনুমতি পাবে। ইতিমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পিএএমসি গঠনে সরকারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ম্যানিলাভিত্তিক একটি উন্নয়ন সংস্থা ইতিমধ্যে সরকারকে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রকারের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।’

খসড়া আইন অনুযায়ী, সরকার ১৩ জন সদস্য পিএএমসির পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে। যার মধ্যে ১২ জন বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে এবং বাকিরা বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) থেকে আসবে। বোর্ডের মেয়াদ তিন বছর হবে এবং একজন সদস্য পরপর দুবারের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পিএএমসির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং এটি কীভাবে চলবে সে সম্পর্কে বিধি তৈরি করবে। পিএএমসি তার আয়ের ওপর কর ছাড়ের সুবিধা পাবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা স্থাপনের অনুমতিও পাবে। সংস্থাটির আয় ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে। পিএএমসির বার্ষিক আর্থিক বিবরণী সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জমা দিতে হবে।

পিএএমসি গঠনে সুপারিশ দেওয়ার জন্য গত মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিই এএমসি গঠনের বিষয়ে ৯ দফা সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করে। এর আগে গত ১৪ মার্চ এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের সঙ্গে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ ধরনের কোম্পানি গঠনের কথা প্রথম বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কিনে পুনরায় ওই ঋণ কোথায় বিক্রি করবে? এ বাজারে খেলাপি ঋণ বেচা যদি এতই সহজ হতো, তাহলে তো ব্যাংকগুলোই ওই কাজটি করতে পারত। যে কাজ ব্যাংকগুলো করতে পারছে না, সে কাজ কীভাবে কল্পিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করবে? এছাড়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করতে গেলে মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন হতে হবে।

ঋণ নিয়ে যারা খেলাপি হয়েছে, তারা এখনো কোর্টে যাবে নিজেদের দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচানোর জন্য। বাংলাদেশে ঋণ বেচাকেনার একটা চলনসই বাজার গড়ে উঠবে, এটা আশা করা যায় না। ঋণ এখন বেচে ব্যাংক আর সে ঋণ কেনেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যখানে অন্য কোনো এজেন্ট বা দালাল নেই। কিন্তু ঋণ বেচাকেনার সেকেন্ডারি মার্কেট দরকার। এটা করতে ঋণের সিকিউরাইটাইজেশন দরকার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের পাশাপাশি নতুন ঋণ বিতরণের আগে পর্ষদকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। ঋণ বিতরণের আগে যাচাই-বাছাই না করলে কোম্পানি গঠন করেও খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না।
জানা গেছে, বাংলাদেশে এ ধরনের কোম্পানি গঠন এবারই প্রথম নয়।

এর আগে ২০০১ সালেও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। ২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস করপোরেশন (পিডিএসসি) লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম শুরু করে। পরে এ জাতীয় আরও কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং সোনালী, অগ্রণীসহ কয়েকটি ব্যাংক তাদের খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেয়। শুরুর দিকে এ ক্ষেত্রে কিছু সফলতা এলেও পরে একশ্রেণির কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টের দুর্নীতির কারণে তা প্রায় ব্যর্থ হয়ে যায়।