মিজানুর রহমান ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের অব্যাংকিং আর্থিক খাতের লিজিং কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমানত, তারল্য ও মুনাফা নিয়ে নিদারুণ সংকটের মধ্যে রয়েছে। দিন যত যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট তত বাড়ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদ ধরে রাখতে পারছে না। এর সঙ্গে মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি তারল্য সংকটের পরিমাণও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো আর্থিক খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংকট বাড়ায় ইতোমধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) অবসায়নের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে। নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিংকে চলতি বছরের জুলাই মাসে অবসায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও পিপলস লিজিংকে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তি আমানতকারীদের সঞ্চয় ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছেন আমানতকারীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আর্থিক খাতের অন্য কোম্পানিগুলোর অবস্থার উন্নতি হয়নি। উল্টো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

এদিকে দেশের পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মৌলভিত্তি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এর ফলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে তুলনামূলক কম ঝুঁকি থাকে। কিন্তু ২০১০ সালের বাজার ধসের পর থেকেই এ দুই খাতের প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিনিয়োগকারীরা। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এর পর থেকেই বাজার ধসের চাপ সামাল দিতে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে বাজার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে। যার প্রভাবে গত ৫/৬ বছর ধরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শেয়ারে মন্দাবস্থা বিরাজ করছিল। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর থেকে আর্থিক খাতের শেয়ারে সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে মোট ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এর মধ্যে ২৩টি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। পুঁজিবাজারের আর্থিক খাতের তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমার সাথে সাথে লোকসানি কোম্পানির সংখ্যাও বেড়েছে।

তবে আর্থিক খাতের বড় ঝড়ের মধ্যে ও ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ইপিএস তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। আর্থিক খাতের অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় ফিনিক্স ফাইন্যান্সের অবস্থা কিছুটা ভালো রয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় কোম্পানির ইপিএস নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ২০১৪ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১.৬৪ টাকা। ইপিএস ধারাবাহিক বেড়ে ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে ২.৩৩ টাকা। দেখা যাক ২০১৯ সালে কেমন ডিভিডেন্ড ও ইপিএস আসছে।

তাছাড়া পুঁজিবাজারের যেকোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের পূর্বে ওই কোম্পানির সার্বিক অবস্থা জেনে নেয়া উচিত। এ জন্য অবশ্যই কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস), শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি), মূল্য আয়ের আনুপাতিক হার (পিই রেশিও) সম্পর্কে জানতে হবে। বিনিয়োগের পূর্বে এসব বিষয় না জানলে কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থা জানতে বা বুঝতে পারবেন না সাধারন বিনিয়োগকারীরা।

যেকোন কোম্পানির পিই রেশিও যত কম থাকবে, সেই কোম্পানিটি বিনিয়োগের জন্য তত ভালো। সাধারনত ৪০ পিই রেশিও স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই মানের উপরে থাকলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ বলে গণ্য হবে। পিই রেশিও থেকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য। এই মূল্যটি যত বেশি থাকবে বিনিয়োগের জন্য ততই ভালো। তাই বিনিয়োগের পূর্বে সেই কোম্পানির খুঁটিনাটি ভালোভাবে জানা খুবই জরুরি।

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড। এই কোম্পানিটির অনুমোদিত মুলধন ৩০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৩৯ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত আয় রয়েছে ১৩৯ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ক্রেডিট রেটিংয়ে দীর্ঘ মেয়াদে হয়েছে ‘এ+’ এবং স্বল্প মেয়াদে হয়েছে “এসটি -২”। গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির ওপেনিং প্রাইস ছিল ২৩ টাকা ১০ পয়সা এবং সর্বশেষ দর ছিল ২৩ টাকা।

গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২৪ টাকা ১০ পয়সায় উঠানামা করে। অপরদিকে, গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৩৫ টাকা ২০ পয়সায় উঠানামা করে। গত ৪ বছরে কোম্পানিটির লভ্যাংশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ২০ শতাংশ নগদ, ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ নগদ, ২০১৭ সালে ২০ শতাংশ নগদ এবং ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করে। তবে কোম্পানিটি ধারাবাহিক ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিলেও ২০১৮ সালে স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। কোম্পানিটির সামনে ডিভিডেন্ডের সময় আসছে।

ডিএসই’র তথ্য মতে, কোম্পানিটির ৫ বছরের পিই রেশিও পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০১৪ সালে পিই রেশিও ছিল ১৬.৪০, ২০১৫ সালে ৯.৫৯, ২০১৬ সালে ছিল ১১.৫৫, ২০১৭ সালে ১৬.০৬ এবং ২০১৮ সালে ছিল ১৪ শতাংশ । গত ৫ বছরে কোম্পানিটির ইপিএস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ইপিএস ছিল ১ টাকা ৬৪ পয়সা, ২০১৫ সালে ২ টাকা ১৮ পয়সা, ২০১৬ সালে ছিল ২ টাকা ৩৩ পয়সা, ২০১৭ সালে ছিল ২ টাকা ৩৫ পয়সা এবং ২০১৮ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৩৩ পয়সা।

অপরদিকে, গত ৫ বছরের শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য বা এনএভি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে কোম্পানিটির এনএভি ছিল ২০ টাকা ৫৯ পয়সা, ২০১৫ সালে ২০ টাকা ৭৬ পয়সা, ২০১৬ সালে ২১ টাকা ৮ পয়সা, ২০১৭ সালে ২১ টাকা ৪১ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ছিল ২৩ টাকা ৭১ পয়সা।

ফিনিক্স ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড এর মোট শেয়ার সংখ্যা ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৩১ টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা/পরিচালকের হাতে রয়েছে ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ শেয়ার। কোম্পানিটির সর্বশেষ কোয়াটার অর্থাৎ তৃতীয় প্রান্তিকে ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর,১৯) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ২৬ পয়সা।

আগের বছর একই সময়ে আয় ছিল ৪৯ পয়সা। ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর,১৯) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৮৯ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে আয় ছিল ১ টাকা ২৫ পয়সা। এ সময় নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো পার শেয়ার ( এনওসিএফপিএস ) আয় হয়েছে ১ টাকা ৩২ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে এনওসিএফপিএস হয়েছিল ৫ টাকা ৯ পয়সা।

এছাড়া ৩০ সেপ্টেম্বর,১৯ শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ২১ টাকা ৫১ পয়সা যা আগের বছর ৩০ ডিসেম্বর ১৮ ছিল ২০ টাকা ৬২ পয়সা। ফিনিক্স ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড এর চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন আজিজুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন এস.এম ইন্তেখাব আলম। ফিনিক্স ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড ২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বর্তমানে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভলো নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থা নেই। ফলে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। আবার বিতরণ ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। যে কারণে তারল্য সংকটে পড়ে অনেকে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। সার্বিকভাবে তারল্য ও মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় কোম্পানির সম্পদের মূল্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে তার মধ্যে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের অবস্থা কিছুটা ভালো। এটা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত সময়। কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ভালো ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে।