দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাস দুর্যোগে বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যে কর্মহীন মানুষ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলা এখনো থামানো যায়নি। হতদরিদ্রদের জন্য ১০টাকা কেজি দরে যে চাল দেয়া হচ্ছে, বেশ কয়েকটি এলাকায় সেই চাল নিয়ে দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার জেল জরিমানা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে, লকডাউন চলার দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে এসেও সারাদেশে দরিদ্র এবং কর্মহীন মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরির কাজই শেষ হয়নি। কর্মকর্তারা বলেছেন, দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে ত্রাণ বিতরণে একটা সমন্বয় করার চেষ্টা তারা করছেন।

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বগুড়ার দুটি উপজেলায় দরিদ্র মানুষের কাছে কার্ডের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগে দুজন ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারা দুজনই দুটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতা।

তাদের একজন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার একটি ইউনিয়নে একজন ডিলার হিসাবে চাল আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছিলেন। তেমন অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পেয়ে প্রশাসন তার জরিমানা করেছে। আরেকজন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার একটি ইউনিয়নে ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণে দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন।

সারিয়াকান্দি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল মিয়া বিবিসিকে বলেন, একটা ইউনিয়নে ডিলারদের জন্য যে বরাদ্দ আছে তার মধ্যে একজনের নাম গাজিউল হক। তার জন্য ৫০০ বস্তা বরাদ্দ ছিল। উনি ৫০০ বস্তা চালই তুলেছেন। কিন্তু আমরা তার গুদামে গিয়ে ২১২ বস্তা চাল পাই। বাকি চালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিতরণ করেছেন বলে জানান। কিন্তু বিতরণের তালিকা দেখে আমাদের সন্দেহ হয়।

সন্দেহ হওয়ার চাল বিতরণের তালিকা ধরে কয়েকজনের বাসায় গিয়ে কথা বলেন কর্মকর্তারা। তিনি জানান, সেসময় একজন বলেন, তার নামে যে কার্ড হয়েছে সেটাই তিনি জানেন না। আরেকজন বলেন, এবার চাল আসেনি, টাকা এসেছে। ২৫০ টাকা তাকে দেওয়া হয়েছে। অথচ কার্ডধারিকে ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি চাল দেওয়ার কথা ছিল।

এসব প্রমাণ পেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই ডিলারকে এক মাসের জেল দেয়া হয়েছে বলে জানান রাসেল মিয়া। দুদিন আগে দক্ষিণ পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার একটি ইউনিয়নেও একজন ডিলার হিসাবে স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা ১০ টাকা কেজির চাল বাজারে বিক্রি করে ধরা পড়েছেন।

ঢাকায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র একজন নেতা বলেছেন, এ ধরনের অনিয়মের সাথে তাদের দলের যাদের বিরুদ্ধে আভিযোগ আসছে, তাদের ব্যাপারে দল থেকেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ১০ টাকা কেজি দরে একটি পরিবারকে ৩০কেজি করে চাল দেয়ার জন্য ৫০ লাখ মানুষের একটি তালিকা করা হয়েছিল প্রায় ১০ বছর আগে। এত বছরের পুরোনো তালিকা নবায়ন না করার কারণেও সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এর বাইরে এখন লকডাউনের কারণে কর্মহীন এবং দরিদ্র প্রতিটি পরিবারের তালিকা করে বিশেষ ত্রাণ হিসাবে ১০ কেজি করে চাল ঘরে ঘরে বিতরণের কার্যক্রমের কথা বলছে সরকার। কিন্তু অনেক মানুষ কোনো সাহায্যই পাচ্ছেন না।

শরিয়তপুর জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে এক নারী বলেন, আমার চারটা সন্তান। কিন্তু কোনো সাহায্য পাই নাই। করোনার কারণে এখন কোনো কাজ নাই। সব বন্ধ। ফলে জীবন চালানো কঠিন হয়ে গেছে, বুঝলেন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরও ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না। আর ব্যক্তিগতভাবে বা বেসরকারিভাবেও ত্রাণ বিতরণে জনসমাগম করে বিশৃঙ্খলতা চলছে এবং তাতে সামাজিক দূরত্ব ভেঙে পড়ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন নঈম ওয়াহারা। তিনি বলছিলেন, মাঠ পর্যায়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা বিভিন্নভাবে খবর আমরা পাচ্ছি। আমাদের যে পুরাতন ধাঁচের রিলিফ বিতরণ প্রক্রিয়া আছে, সেটার ওপরই আমরা নির্ভর করছি। সেটা করতে গিয়ে মানুষের ভিড় বাড়ছে এবং যার বেশি প্রয়োজন, তার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণে দুর্নীতি বা অনিয়মের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কোনো ছাড়া দেয়া হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন। তালিকা শেষ হয়নি: কর্মহীন নিম্ন-আয়ের এবং দরিদ্র তিন কোটি মানুষকে বিশেষ ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার কথা সরকার বলছে, কিন্তু সেই তালিকা এখনও করা যায়নি।

প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, আমরা সারাদেশে ২৯ লাখ ৭৫ হাজার পরিবারের তালিকা করতে পেরেছি। প্রতি পরিবারে চারজন করে সদস্য ধরা হলে এক কোটি ২০ লাখ লোকের তালিকা হয়েছে। এখনো প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ লোক তালিকার বাইরে আছে। একেবারে গ্রামের ওয়ার্ড পর্যায়ে তালিকা তৈরি বেশ কঠিন। সেজন্য কিছুটা সময় লাগছে। তবে একদিকে তালিকা তৈরির কাজ চলছে, একইসাথে ত্রাণ বিতরণও করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে এই তালিকা করে ঘরে ঘরে চাল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এবং এখানে কোনো বিশৃঙ্খলা নাই। তবে বেসরকারি ত্রাণ বিতরণে জনসমাগম করার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। মন্ত্রী আরো জানান, এবার লম্বা সময় ধরে এই ত্রাণ সহায়তা দিতে হতে পারে। সেটা বিবেচনায় রেখে তারা কাজ করছেন। সূত্র: কাদির কল্লোলের প্রতিবেদন, বিবিসি বাংলা, বিশেষ খবর