দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রণয়ন করা কর্পোরেট গভর্নেন্স কোডের (সিজিসি) সব শর্ত তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য পরিপালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একইভাবে সিজিসি’র শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে কোম্পানিগুলোকে সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য কমপ্লায়েন্স অডিটরদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে সে শর্ত মানছেন না বিমাখাতের ৭টি কোম্পানি ও তাদের কমপ্লায়েন্স অডিটর।

বিমাখাতের এসব কোম্পানির মধ্যে কিছু কোম্পানি ভুল ‘কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট’ তৈরি করেছে। আবার কিছু ‘কমপ্লায়েন্স অডিটর’ ওই কোম্পানিগুলোর রিপোর্টে ভুল ‘কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট’ দিয়েছে। ফলে এ ধরনের অসঙ্গতি এবং ভুল সিজিসি পুরোপুরি লঙ্ঘন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুঁজিবাজারে বিমাখাতে তালিকাভুক্ত ৪৭টি কোম্পানির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করে সিজিসি পরিপালনের ক্ষেত্রে এসব অসঙ্গতির তথ্য পেয়েছে রাইজিংবিডি।

ভুল কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করা কোম্পানি এবং কমপ্লায়েন্স অডিটররা হলেন- অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স ও প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর আতিক খালেদ চৌধুরী চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের ম্যানেজিং পার্টনার মো. আতিকুর রহমান, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর কাজী জহির খান অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার নুরুল হোসেন খান, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর ম্যাবস অ্যান্ড জে পার্টনার্স চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের সিনিয়র পার্টনার নাসির উদ্দিন আহমেদ,

স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর টি. হোসেন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার মোহাম্মদ আবু কাওসার, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর শফিক বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার মো. এনায়েত উল্লাহ এবং সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর কেএপিএস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার পুলক কুমার দাস।

মূলত ওই বিমা কোম্পানিগুলোর কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্টে সিজিসি পরিপালনের শর্ত যাচাই-বাছাই না করেই নামকাওয়াস্তে ‘কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট’ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটর। এমনকি তারা সিজিসি’র পরিবর্তে কোম্পানিগুলোকে কর্পোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইন (সিজিজি) অনুযায়ী সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। একইভাবে ওই কমপ্লায়েন্স অডিটরদের মতোই বেশ কিছু কোম্পানিও সিজিসি’র পরিবর্ত সিজিজি অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করছে।

আর এসব অসঙ্গতি ও ভুলগুলোকে ‘অডিট আপত্তি’ হিসেবে তুলে না ধরে, কোম্পানিগুলোর সার্টিফিকেটে মূল্যায়ন স্বরূপ ‘হাইলি সেটিসফ্যাক্টরি’ (পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি) অথবা ‘সেটিসফ্যাক্টরি’ (সন্তুষ্টি) দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটর। ফলে এ ধরনের অসঙ্গতির দায় কোম্পানি ও কমপ্লায়েন্স অডিটর কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বিমাখাতের ৭টি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যত্যয় পাওয়া গেছে দু’টির কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেটে। কোম্পানি দু’টি হলো- অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স ও প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এ দু’টি কোম্পানির কমপ্লায়েন্স রিপোর্টে সিজিসি’র পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটর সিজিজি অনুযায়ী সার্টিফিকেট দিয়েছেন, যা সিজিসি পুরোপুরি লঙ্ঘন।

একইভাবে অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স তাদের কমপ্লায়েন্স অডিটরের মতোই সমানভাবে সিজিসি লঙ্ঘন করেছে। কারণ কোম্পানিগুলো সিজিসি’র পরিবর্তে ভুলবশত সিজিজি অনুসারে কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করেছে। ফলে কোম্পানিটি ও সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিট সমানভাবে সিজিসি লঙ্ঘন করেছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি ভুল সংশোধনের দায়-দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটরের। কিন্তু কমপ্লায়েন্স অডিটর কোম্পানিগুলোকে খুশি রাখতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ পেতে নামকাওয়াস্তে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। যা সিজিসি পুরোপুরি লঙ্ঘন।

তবে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স সিজিসি অনুসরণ করে কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করেছে। সিজিজি অনুসারে সার্টিফিকেট দিয়ে ভুল করেছেন সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটর।

অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, বিমাখাতের অন্য ৫টি কোম্পানির কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেটে সমগোত্রীয় ভুল পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে ওই কোম্পানিগুলো সিজিসি অনুসরণ করে কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করলেও সার্টিফিকেট দিতে ভুল করেছেন সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটররা। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি সিজিসি’র সব শর্ত ‘পরিপালন করেছে’ অথবা ‘পরিপালন করেনি’; কোম্পানিটি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) এর বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়াল স্ট্যান্ডার্ড (বিএসএস) ‘পরিপালন করেছে’

অথবা ‘পরিপালন করেনি’; কোম্পানি আইন ১৯৯৪, সিকিউরিটিজ আইন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইন মেনে কোম্পানিটির হিসাব-নিকাশ ‘সংরক্ষিত রাখা হয়েছে’ অথবা ‘সংরক্ষিত রাখা হয়নি’ এবং কোম্পানিটি প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ভিত্তিতে মূল্যায়ন স্বরূপ ‘হাইলি সেটিসফ্যাক্টরি’ অথবা ‘সেটিসফ্যাক্টরি’ অথবা ‘নট সেটিসফ্যাক্টরি’ (অসন্তুষ্টি) পাবে তা পৃথকভাবে সুস্পষ্ট উল্লেখ করার কথা ছিল কমপ্লায়েন্স অডিটরদের। কিন্তু কোম্পানিগুলোর সার্টিফিকেটে সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটররা সিজিসি’র ওই শর্তগুলো আংশিক বা হুবহু তুলে ধরেছেন। ফলে সার্টিফিকেট দেখে কোম্পানিগুলোর সিজিসি পরিপালনের সার্বিক চিত্র সঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না, যা সিজিসি পরিপন্থি।

এ বিষয়ে অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিট আতিক খালেদ চৌধুরী চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের ম্যানেজিং পার্টনার মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্টের আদলেই ভুলবশত কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট তৈরি করা হয়েছে।’

এদিকে অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি সচিব মো. মোফিজুর রহমান বলেন, ‘ওই সময়ে কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড পরিপালনের বিষয়টি খেয়াল ছিল না। তাই ২০১৭ সালের আদলেই ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সিজিজি অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করা হয়।’

প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর ম্যাবস অ্যান্ড জে পার্টনার্স চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের সিনিয়র পার্টনার নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় হয়তো ভুল হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো সতর্ক থাকবো।’

এদিকে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব জগদীশ কুমার ভঞ্জন বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স অডিট সার্টিফিকেট দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কমপ্লায়েন্স অডিটর। এক্ষেত্রে কোম্পানির কিছুই করার ছিলো না।’

এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর টি. হোসেন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার মোহাম্মদ আবু কাওসার এবং সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স অডিটর শফিক বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার মো. এনায়েত উল্লাহ তাদের দেওয়া কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেটে ভুলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

তবে সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেটে ভুলের বিষয়ে জানতে চাইলে কমপ্লায়েন্স অডিটর কেএপিএস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টসের পার্টনার পুলক কুমার দাস বলেন, ‘সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেটে কোনো অসঙ্গতি নেই। আমি যেভাবে সার্টিফিকেট দিয়েছি তা ঠিক আছে।’

এ বিষয়ে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজারের সকল কোম্পানিকে বাধ্যতামূলক সিজিসি পরিপালন করতে হবে। যেসব কমপ্লায়েন্স অডিটর সার্টিফিকেট দিচ্ছেন তাদেরকেও সিজিসি’র শর্ত মানতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো পক্ষে যদি সিজিসিসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বিএসইসি।’ সুত্র: রাইজিংবিডি