দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেবাসহ বিভিণ্ণ কর্মকান্ডে দলীয় সম্পৃক্ততা আরও বাড়ানো যেত বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতারা। তারা আক্ষেপ করে বলছেন, এসব পরিস্থিতিতে দলের পক্ষ থেকে সেবামূলক কর্মকান্ড জোরদার করার সুযোগ এলেও আওয়ামী লীগ তা করতে পারেনি। স্থানীয় অনেক নেতা সক্রিয় হতে চাইলেও স্থানীয় প্রশাসন তাদের ‘সেভাবে’ গ্রহণ করেনি।

ফলে বাধ্য হয়েই নিষ্ক্রিয় থাকতে হয়েছে দায়িত্বশীল নেতাদের। আবার দলে এখন একটা শ্রেণি আছে যারা দলকে কতটা নিষ্ক্রিয় করে রাখা যায় দিনরাত সেটাই করছেন। যেখানে দলের সক্রিয় ভূমিকা থাকলে ত্রাণ নিয়ে ‘নয়-ছয়’ ও ত্রাণ চুরি ঠেকানো যেত।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ত্রাণ চুরির ঘটনা ঘটছে কেন্দ্রীয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায়। এগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তারা নামকাওয়াস্তে নেতা। জেলা-থানার শীর্ষ নেতাদের সম্পৃক্ত করা হলে ওইসব নামকাওয়াস্তের নেতারা ত্রাণ চুরির সাহস পেত না।

তিনি বলেন, কয়েকটি ঘটনায় শাস্তি হওয়ায় ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় চুরির ঘটনা এখন নেই। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সরকার সারা দেশে সাধারণ ছুটি বা লকডাউন ঘোষণা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সারা দেশের নেতাকর্মীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজে লাগানো যেত। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা, সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের ‘ইনিশিয়েটিভ’ অনেক সময় বেশি কাজের। কেন্দ্র থেকে এক ঘোষণাতেই এটা করা সম্ভব ছিল।

সভাপতিমণ্ডলীর ওই সদস্য আরও বলেন, দুর্যোগ-মহামারীতে রাজনৈতিক ভূমিকা কোন দলের, কোন নেতার কতখানি তা হিসাবে রাখে জনগণ। নেতাদের কার্যকর ভূমিকা নজরে এলে দলগুলো যখন ভোটের জন্য জনগণের কাছে যায় তখন মানুষ মূল্যায়ন করে। তাই এসব পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সেবামূলক কর্মকান্ড জোরদার করার এক ধরনের সুযোগ আসে। কোন দল সে সুযোগ কতটা কাজে লাগাল সেটাই পরবর্তী সময়ে আমলে নেওয়া হয়।

দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহলকে বিষয়টি ভাবার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেশ রূপান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে মাঠ পর্যায়ে গত এক মাসে তেমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতাও তেমন দৃশ্যমান হয়নি। এ নিয়ে সারা দেশে কমবেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে।

তিনি বলেন, দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে কোনো নির্দেশনা না পেয়ে সারা দেশে দলীয় নেতাকর্মীরা সক্রিয় হননি। সক্রিয় হতে চাইলেও স্থানীয় প্রশাসন ‘সেভাবে’ গ্রহণ করেননি স্থানীয় নেতাদের। ফলে বাধ্য হয়েই নিষ্ক্রিয়তায় থাকতে হয়েছে দায়িত্বশীল নেতাদের।

ক্ষমতাসীন দলের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, গত বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের তিনটি নির্দেশনা দেন। যেখানে পাড়া-মহল্লায় দলের পক্ষ থেকে ত্রাণ কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এই নির্দেশনা আরও আগে দেওয়া হলে ত্রাণ নিয়ে চুরির যে অভিযোগ এসেছে, তা আসত না। প্রত্যেক জেলা-থানায় মনিটরিং সেল গঠন করা হলে ত্রাণের সুষম বণ্টন যেমন নিশ্চিত করা যেত তেমনি ত্রাণ চুরির যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে তাও প্রতিরোধ করা যেত।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রকাশ্যে কোনো নির্দেশনা প্রাথমিক অবস্থায় না থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থে সারা দেশেই আওয়ামী লীগের নেতারা সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে সমন্বয় ও মনিটরিং দুর্বল থাকায় আওয়ামী লীগের ঘরে তেমন সুফল আসেনি।

তিনি বলেন, সরকার যে পরিমাণ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে দল নিষ্ক্রিয়তায় থাকায় তা সেভাবে প্রচার না হওয়ায় সরকারের ভূমিকাও অনেক ক্ষেত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে সামষ্টিকভাবে দলের চেয়ে ব্যক্তির প্রচারণা বেশি হয়েছে। সভাপতিমণ্ডলীর ওই সদস্য বলেন, করোনা মোকাবিলায় সারা দেশের স্থানীয় প্রশাসন সর্বত্র সক্রিয় ছিল। সে তুলনায় দলীয় নেতারা ছিল নিষ্ক্রিয়তায়। ফলে রাজনৈতিক ক্রেডিট দল হিসেবে ও নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের ঘরে তুলে আনা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, ত্রাণ বিতরণসহ বিভিনড়ব কাজে স্থানীয় প্রশাসনকে এমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যে সেসব কাজে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করারই সুযোগ হচ্ছে না দলের নেতাদের। স্থানীয় প্রশাসন ‘সেভাবে’ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাজের সুযোগ দিচ্ছে না। ফলে আওয়ামী লীগের ঘরেও সুফল আসছে না।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ভোটের সময়ে মানুষের দরজায় ভোট চাইতে দাঁড়াতে পারবে না আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউই। দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, এ পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে সেবামূলক কাজকর্মগুলো চললেও প্রচারহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতারা মানুষের কাছে প্রশড়ববিদ্ধ হয়ে আছেন। দলকে এ অবস্থা থেকে বাঁচাতে হলে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে, দলীয় সম্পৃক্ততা বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে।

ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে সারা দেশে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু জেলা-থানা পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের ত্রাণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করার ফলে দলের চেয়ে ব্যক্তি প্রচারণাই বেশি ফুটে উঠেছে। তাই সে অর্থে দল বেনিফিট পায়নি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ দিকটা নীতিনির্ধারকদের খেয়াল রাখতে হবে দলের কল্যাণেই।

আওয়ামী লীগের নেতাদের মানুষের সেবায় অবদান রাখতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলার জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় দলকে একেবারেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এটা দলের জন্য কোনোভাবেই ভালো হবে না। ত্রাণ বিতরণে আগে থেকেই দলকে সম্পৃক্ত করা উচিত ছিল। দলে বহু সৎ লোক আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দলই সরকারকে বাঁচিয়েছে। তিনি বলেন, দল নিয়ে অনেক পর্যবেক্ষণ আছে। বলতে পারি না; তাই কষ্ট হয়।

করোনা পরিস্থিতিতে দলের ভূমিকা নিয়ে খেদ জানিয়েছেন তিনটি জেলার তৃণমূল নেতারা। তারা বলেন, আগে ছিল দলের সরকার; এখন হলো সরকারের দল। এখন একটি শ্রেণি আছে দলকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিতে চায়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ওই শ্রেণির খপ্পরে পড়েছেন। দলকে কতটানিষ্ক্রিয়তায় করে রাখা যায় দিনরাত সেটাই করে যাচ্ছেন তারা। ওই নেতারা বলেন, এসব নানা দুর্বলতায় দলে আদর্শিক কর্মীও কমে গেছে। ফলে চোরচোট্টা বাড়ছে।