দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মহাজন’ হিসেবে পরিচিত ছোট একটি কোম্পানির ‘বড় দান’ মারার লিপ্সায় মহামারি করোনার ঝুঁকিতে রয়েছেন ডাক্তার, নার্সসহ সম্মুখযোদ্ধারা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ভুয়া এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে তাদের। আর যারা এসব ভুয়া মাস্ক গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তাদের বদলিসহ নানা হয়রানি করা হচ্ছে।

আমেরিকায় উৎপাদিত এন-৯৫ এর কোনো পণ্য চালান দেশেই আসেনি। অথচ মহামারির সুযোগে ভুয়া মাস্ক তৈরি করে এন-৯৫ এর প্যাকেটে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির মুল হোতা জেএমআই সিরিঞ্জের এমডি রাজ্জাক বলে দেশবাসীর মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএমএসডিকে ভুয়া এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা জেএমআই সিরিঞ্জ এন্ড মেডিকেল ডিভাইস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বৃহৎ করদাতা বিবেচনায় গত বছর সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন নোয়াখালীর এই ব্যবসায়ী।

এদিকে এন-৯৫ মাস্ক জাতিয়াতির ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএমআই’র কর্ণধার আবদুর রাজ্জাকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তদন্ত নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি প্রভাব বিস্তারও। তাই অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, যাদের নাম প্রতিবেদনে এসেছে, তারা এন-৯৫ মাস্কের চালান গ্রহণ করেন। এছাড়া উচ্চ পর্যায়ের কাউকে এই তদন্তের আওতায় আনা বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়নি। করোনা রোগীদের দেখভাল ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার জরুরি ভিত্তিতে এন-৯৫ মাস্ক সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই মাস্ক সরবরাহে জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়।

প্রথমে মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিসৎকরা এ নিয়ে আপত্তি তোলেন। এমনকি বিষয়টি তাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে লিখিতভাবে জানানো হয়। ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর কাছেও নালিশ করা হয়। ওই এক লটেই প্রায় ২০ হাজার এন-৯৫ সরবরাহ করা হয়। দেশে তৈরি করে বিদেশি এন-৯৫ বলে চালিয়ে দেয়ার এই অনিয়মের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সরকারের তরফ থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত টিম গঠন করা হয়। ওই প্রতিবেদন এখন অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান। তিনি বলেন, আমি জানি কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। যেহেতু আমি ওই কমিটিতে ছিলাম না তাই এর বেশি বলতে পারছি না।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এন-৯৫ মাস্ক জালিয়াতি ও দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে গোপনে অনুসন্ধান শুরু করেছে। সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হলে দুদকের অনুসন্ধানে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে এন-৯৫ মাস্কের অনিয়মের বিষয়ে কারও অপরাধ আড়াল করা হলে দুদকের অনুসন্ধানে তা বেরিয়ে আসবে। দুদকের অপর এক কর্মকর্তা জানান, তারা মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন চাইবেন।

এদিকে তদন্ত কমিটির অপর একটি সূত্র জানায়, তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রীর টেবিলে পৌঁছেছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলেননি কেউ। এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রী প্রতিবেদনের বিষয়ে কমিটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সচিবের টেবিল হয়ে সেটি তার কাছে যাবে।

তদন্ত কমিটির কাছে আমাদের প্রতিবেদক পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল- এন-৯৫ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডারের মাধ্যমে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল কিনা, এই মাস্ক বাংলাদেশে তৈরির অনুমতি আছে কিনা? যদি না থাকে বিশ্বের যে চারটি দেশ এন-৯৫ তৈরি করে সেগুলো এনে সরবরাহ করা হয়েছে কিনা, যদি আনা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা মানা হয়েছিল কিনা কিংবা তার আদলে দেশে যদি তৈরি করা হয়ে থাকে সেটা কোনো নীতিমালার ভিত্তিতে করা হয়েছে কিনা, এটি সরবরাহের আগে স্যাম্পল দেখা হয়েছিল কিনা?

কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন, এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি। তবে ছোট করে যদি বলি, বিষয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে গড়ালেও ওই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এখনও এন-৯৫ সরবরাহ করা হচ্ছে কিনা আপনারা খবর নেন। তবে এ বিষয়ে বেশি আর তেমন কিছু বলতে নারাজ কমিটির সদস্যরা।

অন্যদিকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অপেক্ষায় থাকা নকল মাস্ক সরবরাহকারী ও নিন্মমানের কোম্পানি জেএমআই হসপিটাল লিমিটেড। মুলত স্বাস্থ্য খাতে লুটপাটের পর এবার পুঁজিবাজার থেকে লুটপাট করতে চায় জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। এ ধরনের প্রতারক ও বাটপার কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিকট দাবী জানিয়েছেন বিনিয়োগকারী ও বাজার বিশ্লেষকরা। কারন এ জাতীয় কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসে লুটপাট করতে, বরং সাধারন বিনিয়োগকারীদের কিছু দিতে আসে না।

পুঁজিবাজারে আসার প্রক্রিয়ায় থাকা জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফেকচারিং লিমিটেডের বিরুদ্ধে বড় ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এন-৯৫ ফেস মাস্ক এর নামে সাধারণ মানের সার্কিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়েছে। অপরাধের বিষয়টি স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা ও দায়মুক্তি চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

উল্লেখ্য, মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের সংকটেও থেমে নেই স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চিকিৎসাসামগ্রী (ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি, পিপিই, টেস্টিং কিট/ওষুধপত্র) কেনাকাটায় অন্তত ২২ কোটি টাকার সঠিক হিসাব দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ইতিমধ্যে একজন চিকিৎসক ও একজন স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। এরই মধ্যে এন-৯৫ মাস্ক কেনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য অধিদফতর জন্ম দিয়েছে নতুন কেলেঙ্কারি। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুকূলে অর্থ বিভাগ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি বিবরণী ও ব্যয় পরিকল্পনা অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছে অধিদফতর।

এর বাইরে বাকি ১৫০ কোটি টাকা খরচের হিসাব অবশ্য পাঠায়নি তারা। সেখানে ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র, পিপিই, কিট, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ কেনার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। আর ১০০ কোটি টাকা ভবিষ্যৎ ব্যয়ের পরিকল্পনা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার ওই বিবরণীতে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা, যা রীতিমতো এক গোঁজামিলের আশ্রয় বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এ তো গেল অর্থ ব্যয় আর কেনাকাটা সংক্রান্ত অয়িনম-দুর্নীতি আর হিসাবে গোঁজামিলের কথা। এদিকে এন-৯৫ মাস্ক কেনাতেও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে সংশ্লিষ্টরা। বিদেশ থেকে আমদানির কথা বলে দেশীয় কোম্পানি জেএমআই থেকে কেনা হয়েছে এন-৯৫ মাস্ক, যা আদতে এন-৯৫ নয়। বরং সেগুলো সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভুল স্বীকার করে দায়মুক্তি চেয়েছে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শুধু তাই নয়, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত এন-৯৫ মাস্ক করোনা সেবাদানকারী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেখানে করোনা চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হিসেবে ঘোষিত হাসপাতালের বাইরে ঢাকা ও সারা দেশের কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা কোনো চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে এক পিসও এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

আর এন-৯৫ মাস্ক ক্রয় নিয়ে যা হয়েছে তা স্বাস্থ্য অধিদফতরের চরম দায়িত্বহীনতা আর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা। এদিকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে চিকিৎসাসামগ্রী কেনাকাটায় ২২ কোটি টাকার গরমিলের ব্যাখ্যা চেয়েছে অর্থ বিভাগ। কিন্তু এখনো এর সুষ্ঠু জবাব দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। অর্থ বিভাগ থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর প্রায় পুরোটাই ছাড় করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইন এক্সপ্রেসের জন্যও ছাড় করা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।

এটার ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অর্থ বিভাগ। কোয়ারেন্টাইন এক্সপ্রেস বলতে কোন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে কী কী খাতে এ অর্থ খরচ করা হয়েছে, কী কী জিনিসপত্র কেনা হয়েছে, কাকে পরিশোধ করা হয়েছে, এসবের সুস্পষ্ট কোনো বিবরণ অর্থ বিভাগে জমা দেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদফতর। ফলে এসব খরচের পৃথক পৃথক কলামে খরচের বিবরণ দেখিয়ে হিসাব বিবরণী পাঠাতে বলেছে অর্থ বিভাগ।

এদিকে সারা দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এন-৯৫ মাস্ক, পিপিই সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে শুধু ডেডিকেডেট হাসপাতালের বাইরে ঢাকার কিংবা ঢাকার বাইরের অন্য কোনো হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ করা হয়নি। বরং চিকিৎসকরা নিজেদের পয়সায় সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করছেন।

এ বিষয়ে ডক্টরস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডাক্তার শাহেদ রফি পাভেল বলেন, সরকার এখনো করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড ঘোষিত হাসপাতালের বাইরে কোনো হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসককে এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ করেনি। এর ফলে সারা দেশেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। আর নিজেরাই সংক্রমিত হচ্ছেন। এটা খুবই উদ্বেগের।