দেশ প্রতিক্ষণ, বরিশাল: করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কাজ বন্ধ হয়ে বেকায়দায় পড়া গরিব অসহায় জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে সরকার। বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বরাদ্দের চাল বিতরণে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি জনপ্রতিনিধিরা চাল না দিয়ে আত্মসাত করেছেন। ফলে যাদের নামে বরাদ্দ তারা সঠিক ভাবে পায়নি সরকারি সহায়তা। যদিও স্থানীয় প্রশাসন এসব চালচোর জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন তাৎক্ষনিক।

আবার অনেক স্থানে নিয়মিত মামলাও দায়ের হয়েছে। ৩০ এপ্রিল প্রাপ্ত সরকারি তথ্য বিবরণী ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় চাল বিতরণে অনিয়মের ঘটনা মন্ত্রনালয়ের কাছে তথ্য রয়েছে। এই বিভাগে এখন পর্যন্ত ৫০ জন জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগী আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আর ৮৭ মেট্রিক টন ৪২ কেজি চাল বিতরণে অনিয়ম হয়েছে বা অভিযুক্তরা আত্মসাত করেছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের ভোলার উপ-পরিচালক মামুদুর রহমান জানিয়েছেন, জেলায় ওএমএস এবং জেলেদের চাল আত্মসাতের সময় প্রায় ৩ মেট্রিক টন চাল উদ্ধার হয়েছে। চাল চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৯টি। এরমধ্যে লালমোহনে চারটি, চরফ্যাশনে দু’টি, দৌলতখানে একটি ও মনপুরায় দু’টি। চাল চুরির ঘটনায় জড়িত থাকায় ১১ জন গ্রেফতার হয়েছে।

জনপ্রতিনিধি (ইউপি সদস্য) দুই জন। বরখাস্ত হয়েছেন দুই জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও তিন জন ইউপি সদস্য। তাছাড়া শুক্রবার পাঁচ বস্তা চালসহ চরফ্যাশন উপজেলার আহাম্মদপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে ৫বস্তা ভিজিএফ’র সরকারী চাল আত্মসাৎ করার অপরাধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়।

এদিকে বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চুরি যাওয়া ১২. ৩৩ মেট্রিক টন চাল (১২ হাজার ৩৩০ কেজি) চাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ৭ জন। এরমধ্যে জনপ্রতিনিধি ২ জন। আর চাল চুরির সঙ্গে জড়িত থাকায় বহিষ্কার হয়েছেন একজন চেয়ারম্যান এবং দুইজন মেম্বার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। আর যারা পলাতক রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে।

তাছাড়া জেলার গৌরনদীতে দুইজনকে কারাদন্ড, বানারীপাড়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিকে চাল চুরির দায়ে কারাদন্ড প্রদান করা হয়। তাছাড়া ঝালকাঠি জেলায় আত্মসাতের চেষ্টা করার ১৯২ কেজি চাল উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে তিন জন। ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনিরের বাসা থেকে চাল উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে।

মামলার পর তিনি পলাতক রয়েছেন। জেলায় চাল চুরি সংক্রান্ত মোট চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে, একটি থানায় নিয়মিত মামলা, অপরটি জরিমানা। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) আহমেদ হাসান এ তথ্য নিশ্চিতকরেছেন। জেলার নলছিটি উপজেলার কুশঙ্গল ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা আঃ রহিম ১২০ কেজি চাল আত্মসাত করায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত। জানা গেছে, আঃ রহিম তার শালীর নামের ভিজিডি কার্ড দিয়ে চাল মজুদ করেন।

রাজাপুর উপজেলায় সাবেক ইউপি সদস্যের বাসা থেকে ১৮০ কেজি চাল উদ্ধারের ঘটনায় ২ জনকে ৬ মাসের কারাদ- দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। জানা গেছে, রাজাপুর উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের ঘিগড়া গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য (মেম্বার) হোসেন আলীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্থানীয় ডিলার মাহাদি হাসান ও সাবেক ইউপি সদস্য হোসেনের ১৮০ কেজি আত্মসাতকৃত চাল উদ্ধার করে। এছাড়াও বৃহস্পতিবার সোহাগ নামে আরেক ইউপি সদস্যকে বহিস্কার করেছে ওই উপজেলার।

পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির হোসেন মৃধা ৩০০ কেজি চাল চুরি করার ঘটনায় তাকে বহিস্কার করেন স্থানীয় সরকার বিভাগ। ওই চেয়ারম্যানকে চাল চুরির মামলায় ৬ এপ্রিল পটুয়াখালী সদর থানা পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পাঠান। জানা গেছে, ৩১ মার্চ রাতে জেলেদের মাঝে বরাদ্দ দেয়া ভিজিএফের ১০ বস্তা চাল বিতরণ না করে কমলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির মৃধার নির্দেশে পুলিশের হাতে আটককৃত চেয়ারমানের দুই সহযোগী মো. জাকির হোসেন ও ব্যবসায়ী সোহাগ আত্মসাত করেন।

ওদিকে ওই জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন পরিষদের জুগির হাওলা ৬ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মাসুদ তালুকদার (৪৮) ও জুগির হাওলা গ্রামের আলী আকবরের ছেলে আইয়ুব আলী ব্যাপারীর বিরুদ্ধে চাল চুরির মামলা দায়ের হয়েছে। তারা ২৪০ কেজি চাল বিক্রি করেছিলেন। এ ঘটনায় একজন গ্রেফতারও রয়েছেন।

এছাড়া পটুয়াখালী জেলার বাউফলে এক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ঘর থেকে ভিজিডি ও ত্রাণের চাল জব্দ করে ভ্রাম্যমান আদালত। ওই সভানেত্রীকে এক মাসের বিণাশ্রম কারাদ- দেন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আনিচুর রহমান বালী। ত্রাণের চাল চুরি করা সভানেত্রীর নাম মোসা. লিপি আক্তার। তিনি কেশবপুর ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তিনি কেশবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১,২,৩ নম্বর ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য।

এছাড়াও তিনি স্থানীয় সাংসদ আ.স.ম ফিরোজের খালাতো শ্বাশুরি। জানা গেছে, লিপি আক্তারের ঘর থেকে ১ বস্তা ভিজিডি চাল ও চার বস্তা ত্রাণের সরকারি চাল জব্দ করা হয়েছে। তার আগে উপজেলার বগা বন্দর এলাকার একটি গোডাউন থেকে ৪২ মেট্রিকটন সরকারি চাল জব্দ করেছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. শাহজাহান হাওলাদার (৩২) ও মো. জয়নাল চৌকিদার (৬০) নামে দুই ব্যক্তিকে পুলিশ আটক করেছে। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে আটক দুই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে আরও ১০-১২ অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা রুজু করেন। জানা গেছে ওই চাল বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলা থেকে সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজশে বিক্রি করা হয়।

পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায় সরকারের মানবিক সহায়তা কর্মসূচির (জিআর) চাল আত্মসাতের ঘটনায় তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে তারা স্থানীয় কয়েকটি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই জেলার দুদক অফিস এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, উপজেলার ইকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মওদুদ আহম্মেদ লাভলু, ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম, ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শিশির হালদার ও স্থানীয় প্রভাবশালী খোকন সিকদার মিলে ৬০০ কেজি চাল আত্মসাৎ করেন।

একই জেলার নাজিরপুর উপজেলায় হতদরিদ্র পরিবারের ১০ টাকা কেজি দরের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৭৮০ কেজি চাল আত্মসাত করেন কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আবুল কালাম (৫৫)। তাকে সহায়তা করেন দক্ষিণ কলারদোয়ানিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা (৫০) কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ এবং কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়নের উত্তর কলারদোয়ানিয়া গ্রামের হেমায়েত উদ্দিনের ছেলে। বিতরণে অনিয়ম ও কালো বাজারে বিক্রির চেষ্টার অভিযোগে স্থানীয় এক ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশকে ১৫ দিনের কারাদ- দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বরগুনা জেলায় চাল চুরি করে গ্রেফতার হওয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন পল্টুকে বহিস্কার করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নে জেলেদের ভিজিএফ চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনায় তাকে প্রথমে আটক করে পুলিশ। জানা গেছে তিনি ২৭ মেট্রিক টন চাল আত্মসাত করেন।